আধুনিক যুগে স্বাস্থ্য সুরক্ষা মানুষের জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। সুস্থ জীবনযাপনের জন্য স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা অর্জন করা এবং নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই প্রেক্ষাপটে, মিডিয়া একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। মিডিয়া স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য, পরামর্শ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই আর্টিকেলে আমরা স্বাস্থ্য সুরক্ষা কাকে বলে, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মিডিয়ার ইতিবাচক প্রভাব ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাবফেলে তা বিশ্লেষণ করব। আমরা বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া যেমন টেলিভিশন, রেডিও, প্রিন্ট মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্যের প্রচার এবং এর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করব।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা কাকে বলে?
স্বাস্থ্য সুরক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি, সমাজ এবং পরিবেশকে রোগ, আঘাত এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে রক্ষা করা হয়। এটি শুধুমাত্র চিকিৎসা দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং স্বাস্থ্য সুরক্ষার মধ্যে রয়েছে রোগ প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন প্রচার এবং স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা নিশ্চিত করা।
সহজ কথায়, স্বাস্থ্য সুরক্ষা মানেই সুস্থ থাকার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এটি ব্যক্তিগত স্তরে শুরু হয়ে সমাজ এবং রাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত। স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাধ্যমে আমরা আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে পারি, জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারি এবং সমাজকে আরও সুস্থ ও সতেজ রাখতে পারি।
স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিভিন্ন উপায় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সুষম খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম করা, পর্যাপ্ত ঘুম নেয়া, ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করা, নিরাপদ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা, রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ানো এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। এছাড়াও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, পরিবেশ দূষণ রোধ করা, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করা ইত্যাদি স্বাস্থ্য সুরক্ষার অন্তর্গত।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র সবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যক্তিদের সকলেরই যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মিডিয়ার ইতিবাচক প্রভাব
মিডিয়া, বিশেষ করে গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য প্রচার করে, সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন প্রচার করে। মিডিয়ার এই ইতিবাচক প্রভাবগুলো শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে লক্ষণীয়।
শারীরিক প্রভাব
স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য প্রচার: মিডিয়া বিভিন্ন রোগের লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে তথ্য প্রচার করে। এটি মানুষকে তাদের স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন করে তোলে এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণে সাহায্য করে।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের প্রচার: মিডিয়া স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, ধূমপান ও মদ্যপান পরিহারের মতো স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের গুরুত্ব সম্পর্কে প্রচার করে। এটি মানুষকে সুস্থ থাকতে এবং দীর্ঘজীবী হতে অনুপ্রাণিত করে।
রোগ প্রতিরোধে সহায়তা: মিডিয়া বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে তথ্য প্রচার করে। উদাহরণস্বরূপ, কোভিড-১৯ মহামারীর সময় মিডিয়া মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং হাত ধোয়ার মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করেছে।
মানসিক প্রভাব
মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কুসংস্কার দূরীকরণ: মিডিয়া মানসিক রোগ সম্পর্কিত কুসংস্কার দূরীকরণে সাহায্য করে। এটি মানুষকে মানসিক রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেয় এবং চিকিৎসা গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা তৈরি: মিডিয়া মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা তৈরি করে। এটি মানুষকে তাদের অনুভূতি এবং সমস্যা শেয়ার করতে সাহায্য করে এবং একাকীত্বের অনুভূতি কমায়।
মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সহায়তা সেবা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি: মিডিয়া মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন সহায়তা সেবা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। এটি মানুষকে সহায়তা পাওয়ার পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করে।
সামাজিক প্রভাব
সমাজে বসবাসরত সকলের আচরণ, অর্থনৈতিক সাম্য এবং পরিবেশ, সামাজিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে মিডিয়া বিভিন্ন তথ্য প্রদান করে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
সামাজিক সমস্যা সমাধানে সহায়তা: মিডিয়া বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা, যেমন ধূমপান, মাদকাসক্তি, এবং লিঙ্গ ভেদাভেদ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। এটি সমাজকে এই সমস্যাগুলো সমাধানে সাহায্য করে।
সামাজিক পরিবর্তন আনতে সহায়তা: মিডিয়া সামাজিক পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, মিডিয়া নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু শ্রম নিরোধ এবং পরিবেশ সুরক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে।
সামাজিক একতা বৃদ্ধি: মিডিয়া বিভিন্ন সামাজিক ঘটনা এবং সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করে এবং সামাজিক একতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব
মিডিয়ায় প্রায়ই অনেক ভুল তথ্য প্রদান করতে দেখা যায়। এসব তথ্যকে বিশ্বাস করে আমরা আমাদের জীবন সাজানোর চিন্তাভাবনাগুলো ভুল পথে পরিচালনা করে থাকি।
শারীরিক প্রভাব
অতিরিক্ত বসে থাকা: মোবাইল, কম্পিউটার, ট্যাবলেট ইত্যাদির ব্যবহার বাড়ার ফলে অনেকেই দীর্ঘ সময় বসে থাকেন। এতে মোটা হওয়া, পিঠের ব্যথা, ঘাড়ের ব্যথা, চোখের সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে।
ঘুমের ব্যাঘাত: সোশ্যাল মিডিয়া, গেমিং ইত্যাদির আসক্তি ঘুমের সময় কমিয়ে দেয়। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়।
অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রচার: মিডিয়ায় বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর খাবারের বিজ্ঞাপন প্রচুর পরিমাণে দেখানো হয়। এটি অনেককেই অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে উৎসাহিত করে।
শারীরিক সক্রিয়তা কমে যাওয়া: মিডিয়ার আসক্তির কারণে অনেকেই বাইরে গিয়ে খেলাধুলা বা শারীরিক পরিশ্রম করতে চায় না। এতে শরীর অকেজো হয়ে পড়তে পারে।
মানসিক প্রভাব
চাপ ও উদ্বেগ: সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের সাফল্য দেখে অনেকেই নিজেকে অনুপযুক্ত মনে করতে পারে এবং চাপ ও উদ্বেগ অনুভব করতে পারে।
একাকিত্ব: মিডিয়ার আসক্তির কারণে অনেকেই বাস্তব জীবনের সম্পর্ককে উপেক্ষা করে এবং একাকিত্ব বোধ করতে পারে।
মনোযোগ কমে যাওয়া: মিডিয়ার বিভিন্ন বিষয়বস্তু একযোগে দেখার কারণে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে সমস্যা হয়।
হিংসা ও বিদ্বেষ: মিডিয়ায় প্রচারিত হিংসাত্মক ও বিদ্বেষপূর্ণ বিষয়বস্তু মানসিকতা নষ্ট করতে পারে।
সামাজিক প্রভাব
সামাজিক সম্পর্কের অবনতি: মিডিয়ার ব্যবহার বাড়ার ফলে পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো কমে যায় এবং সামাজিক সম্পর্কের অবনতি হয়।
অপরাধ: মিডিয়ায় প্রচারিত অপরাধমূলক ঘটনা অনুকরণ করে অনেকেই অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
মিথ্যা তথ্যের প্রসার: মিডিয়ায় অনেক সময় মিথ্যা তথ্য প্রচারিত হয়, যা সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
সামাজিক বৈষম্য: মিডিয়ায় নির্দিষ্ট ধরনের মানুষকে উচ্চমানের এবং অন্যদের নিম্নমানের হিসেবে দেখানো হয়, যা সামাজিক বৈষম্যকে বাড়িয়ে তোলে।
মিডিয়া আমাদের জীবনে অনেক ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে এর নেতিবাচক প্রভাবও কম নয়। সুতরাং, মিডিয়ার ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য মিডিয়ার ব্যবহার সীমিত করা, বাস্তব জীবনের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া এবং সঠিক তথ্যের উৎস খুঁজে বের করা জরুরী।
আরো পড়ুনঃ