মিনু – বনফুল
মা-মরা মেয়ে মিনু। বাবা জন্মের আগেই মারা গেছে। সে মানুষ হচ্ছে এক দূরসম্পর্কের পিসিমার বাড়িতে। বয়স মাত্র দশ, কিন্তু এই বয়সেই সবরকম কাজ করতে পারে সে। সবরকম কাজই করতে হয়। লোকে অবশ্য বলে যোগেন বসাক মহৎ লোক বলেই অনাথা বোবা মেয়েটাকে আশ্রয় দিয়েছেন। মহৎ হয়ে সুবিধাই হয়েছে যোগেন বসাকের। পেটভাতায় এমন সর্বগুণান্বিতা চব্বিশ ঘণ্টার চাকরানী পাওয়া শক্ত হতো তাঁর পক্ষে। বোবা হওয়াতে আরো সুবিধা হয়েছে, নীরবে কাজ করে। মিনু শুধু বোবা নয়, ঈষৎ কালাও। অনেক চেঁচিয়ে বললে, তবে শুনতে পায়। সব কথা শোনার দরকারও হয় না তার। ঠোঁটনাড়া আর মুখের ভাব দেখেই সব বুঝতে পারে। এছাড়া তার আর একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে যার সাহায্যে সে এমন সব জিনিস বুঝতে পারে, এমন সব জিনিস মনে মনে সৃষ্টি করে, সাধারণ বুদ্ধিতে যার মানে হয় না। মিনুর জগৎ চোখের জগৎ, দৃষ্টির ভিতর দিয়েই সৃষ্টিকে গ্রহণ করেছে সে। শুধু গ্রহণ করে নি, নতুন রূপে নতুন রং আরোপ করেছে তাতে।
খুব ভোরে ওঠে সে। ভোর চারটের সময়। উঠেই দেখতে পায় পূর্ব আকাশে দপদপ করে জ্বলছে শুকতারা। পরিচিত বন্ধুকে দেখলে মুখে যেমন মৃদু হাসি ফুটে ওঠে, তেমনি হাসি ফুটে ওঠে মিনুর মুখেও। মিনু মনে মনে বলে-সই ঠিক সময়ে উঠেছ দেখছি। বৈজ্ঞানিকের চোখে শুকতারা বিরাট বিশাল বাষ্পমণ্ডিত প্রকাণ্ড গ্রহ, কবির চোখে নিশাবসানের আলোকদূত, কিন্তু মিনুর চোখে সে সই। মিনুর বিশ্বাস সে-ও তার মতো কয়লা ভাঙতে উঠেছে ভোর বেলায়, আকাশবাসী তার কোনো পিসেমশায়ের গৃহস্থালিতে উনুন ধরাবার জন্যে। আকাশের পিসেমশায়ও হয়তো ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করে তার নিজের পিসেমশায়ের মতো। শুকতারার আশেপাশে কালো মেঘের টুকরো যখন দেখতে পায়, তখন ভাবে ঐ যে কয়লা। কী বিচ্ছিরি করে ছড়িয়ে রেখেছে আজ। বলে আর মুচকি মুচকি হাসে। তারপর নিজে যায় সে কয়লা ভাঙতে। কয়লাগুলো ওর শত্রু। শত্রুর উপর হাতুড়ি চালিয়ে ভারি তৃপ্তি হয় ওর। হাতুড়িটার নাম রেখেছে গদাই, আর যে পাথরটার উপর
রেখে কয়লা ভাঙে তার নাম দিয়েছে শানু। শানের সঙ্গে মিল আছে বলে বোধ হয়। কয়লা-গাদার কাছে গিয়ে রোজ সে ওদের মনে মনে ডাকে-ও গদাই ও শানু ওঠো এবার, রাত যে পুইয়ে গেছে। সই এসে কয়লা ভাঙছে। তোমরাও ওঠো, কয়লা ভেঙে তারপর যায় সে খুঁটের কাছে। ঘুঁটে তার কাছে খুঁটে নয়, তরকারি। উনুনের নাম রাক্ষসী। উনুন রাক্ষসী কেরোসিন তেল দেওয়া ঘুঁটের তরকারি দিয়ে শত্রুদের মানে কয়লাদের খাবে। আঁচটা যখন গনগন করে ধরে ওঠে তখন ভারি আনন্দ হয় মিনুর। জ্বলন্ত কয়লাগুলোকে তার মনে হয় রক্তাক্ত মাংস, আর আগুনের লাল আভাকে মনে হয় রাক্ষসীর তৃপ্তি। বিস্ফারিত নয়নে সে চেয়ে থাকে। তারপর ছুটে চলে যায় উঠোনে; আকাশের দিকে চেয়ে দেখে সেখানে উষার লাল আভা ফুটছে কি না। উষার লাল আভ্য যেদিন ভালো করে ফোটে সেদিন সে ভাবে সইয়ের উনুনে চমৎকার আঁচ এসেছে। যেদিন আকাশ মেঘে ঢাকা থাকে সেদিন ভাবে, ছাই পরিষ্কার করে নি, তাই আঁচ ওঠে নি আজ। এইভাবে নিজের একটা অভিনব জগৎ সৃষ্টি করেছে সে মনে মনে। সে জগতের সঙ্গে বাইরের জগতের মিল নেই। সে জগতে তার শত্রু-মিত্র সব আছে। আগেই বলেছি কয়লা তার শত্রু। রান্নাঘরের বাসনগুলি সব তার বন্ধু। তাদের নাম রেখেছে সে আলাদা আলাদা। ঘটিটার নাম পুটি। ঘটিটা একদিন হাত থেকে পড়ে পিরে তুবড়ে গেল। মিনুর সে কী কান্না। তোবড়ানো জায়গাটায় রোজ হাত বুলিয়ে দেয়। গেলাস চারটের নাম হাবু, বাবু, তাবু আর কাবু। চারটে গেলাসই একরকম। কিন্তু মিনুর চোখে তাদের পার্থক্য ধরা পড়ে। গেলাসগুলোকে যখন মাজে বা ধোয় তখন মনে হয় সে যেন ছোট ছেলেদের স্নান করাচ্ছে। মিটসেফটা ওর শত্রু। ওটার নাম দিয়েছে গণগলা। গপগণ করে সব জিনিস পেটে পুরে নেয়। মাঝে মাঝে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে মিটসেফের চকচকে তালাটার দিকে, আর মনে মনে বলে-
আ মর, মুখপোড়া সব জিনিস পেটে খুরে বসে আছে। মিনুর আর একটি দৈনন্দিন কর্তব্য আছে। যখন অবসর পায় টুক করে চলে যায় ছাদে। ছাদ থেকে একটা বড় কাঁঠাল গাছ দেখা যায়। কাঁঠাল গাছের মাথার দিক থেকে একটা সরু শুকনো ডাল বেরিয়ে আছে। সেই ডালটার দিকে সাগ্রহে চেয়ে থাকে মিনু। মনে হয় তার সমস্ত অন্তর যেন তার দৃষ্টিপথে বেরিয়ে গিয়ে আশ্রয় করেছে ওই ডালটাকে। এর কারণ আছে। তার জন্মের পূর্বেই তার বাবার মৃত্যু হয়েছিল। বাবাকে সে দেখে নি। অনেকদিন আগে তার মাসিমা তার কানের কাছে চিৎকার করে একটা বিস্ময়কর খবর বলেছিল। তার বাবা নাকি বিদেশ গেছে, অনেক দূর বিদেশ, মিনু বড় হলে তার কাছে ফিরে আসবে, হয়তো তার কোলেই আসবে। মিনু বুঝতে পারে নি ব্যাপারটা ভালো করে। একটা জিনিস কেবল তার মনে গাঁথা হয়ে ছিল, বাবা ফিরে আসবে। কবে আসবে? মিনু কত বড় হলে আসবে? কথাটা মাঝে মাঝে ভাবত সে।
এমন সময় একদিন একটা ঘটনা ঘটল। সে সেদিনও ছাদে দাঁড়িয়েছিল। দেখতে পেল পাশের বাড়ির টুনুর বাবা এলো বিদেশ থেকে অনেক জিনিসপত্র নিয়ে, আর ঠিক সেই সময়ে তার নজরে পড়ল ঐ সরু ডালটায় একটা হলদে পাখিও এসে বসল। সেদিন থেকে তার বদ্ধ ধারণা হয়ে গেছে ওই সরু ডালে যেদিন হলদে পাখি এসে আবার বসবে, সেদিনই তার বাবা আসবে বিদেশ থেকে। তাই ফাঁক পেলেই সে ছাদে ওঠে। কাঁঠাল গাছের ওই সরু ডালটার দিকে চেয়ে থাকে। হলদে পাখি কিন্তু আর এসে বসে না। তবু রোজ একবার ছাদে ওঠে মিনু। এটা তার দৈনন্দিন কর্তব্যের মধ্যে একটা। এর কয়েকদিন পর রাত্রে কম্প দিয়ে জ্বর এলো তার। কাউকে কিছু বললে না। মনে হলো জ্বর হওয়াটাও বুঝি অপরাধ একটা। ভোরে ঘুম ভেঙে গেল, রোজ যেমন কয়লা ভাঙতে যায় সেদিনও তেমনি গেল, সেদিনও চোখে পড়ল শুকতারাটা দপদপ করে জ্বলছে। মনে মনে বলল-সই এসেছিস। আমার শরীরটা আজ ভালো নেই ভাই। তুই ভালো আছিস তো? উনুনে আঁচ দিয়ে কিন্তু সে আর জল ভরতে পারল না সেদিন। শরীরটা বড্ড বেশি খারাপ হতে লাগল। আস্তে আস্তে গিয়ে শুয়ে পড়ল নিজের বিছানায়। কেমন যেন ঘোর-ঘোর মনে হতে লাগল। নিজের ছোট্ট ঘরটিতে মিনু জ্বরের ঘোরে শুয়ে রইল খানিকক্ষণ। জ্বরের ঘোরেই হঠাৎ তার মনে হয় একটা দরকারি কাজ করা হয় নি। আস্তে আস্তে উঠল সে বিছানা থেকে, তারপর খিড়কির দরজা দিয়ে গিয়ে দাঁড়াল ছাদের সিঁড়ির কাছে। সিঁড়ির কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে উঠে গেল ছাদে। কেউ দেখতে পেল না। পিসিমা পিসেমশাই তখনও ঘুমুচ্ছেন। ছাদে উঠেই চোখে পড়ল লালে লাল হয়ে গেছে পূর্বাকাশ। বাঃ চমৎকার আঁচ উঠেছে তো সইয়ের। একটু হাসল সে। তারপর চাইল সেই সরু ডালটার দিকে। সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল তার। একটা হলদে পাখি এসে বসেছে। তাহলে তো বাবা নিশ্চয় এসেছে। আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না ছাদে। যদিও পা টলছিল তবু সে প্রায় ছুটে বেরিয়ে এলো বাইরে।