হাতি আর শিয়ালের গল্প

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। চারদিকে তখন কী সুন্দর সবুজ বন, ঝোপঝাড়। আর দিগন্তে ঝুঁকে-পড়া নীল আকাশের ছোঁয়া। মানুষ ও প্রাণীরা ছিল খুব শান্তিতে।

মানুষ তখন একটু একটু করে সভ্য হচ্ছে। কী করে সবার সাথে মিলেমিশে থাকা যায়, শিখছে সেইসব কায়দাকানুন। ওদিকে বনে বনে তখন পশুদের রাজত্ব। হাজার রকমের প্রাণী, অসংখ্য পাখ-পাখালি। বেশ শান্তিতেই কাটছিল বনের পাখি আর প্রাণীদের দিনগুলো। কিন্তু একদিন হলো কি, তাড়া খেয়ে মস্ত একটা হাতি ওই বনে ঢুকে পড়ল। হাতিটার সে-কী বিশাল শরীর। পা-গুলো বটপাকুড় গাছের মতো মোটা। শুঁড় এতটাই লম্বা যে, আকাশের গায়ে গিয়ে বুঝি ঠেকবে। তার গায়েও অসীম জোর। এই শরীর আর শক্তি নিয়েই তার যত অহংকার। তাছাড়া মেজাজটাও দারুণ তিরিক্ষি।

হাতি আর শিয়ালের গল্প

যেই-না হাতিটার ঐ বনে ঢোকা, অমনি শুরু হয়ে গেল তোলপাড়। নতুন অতিথি এসেছে, সবাই স্বাগত জানাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। কিন্তু দুষ্টু হাতিটার তখন সে-কী তুলকালাম কাণ্ড। খুব জোরে গলা ফাটিয়ে দিল প্রচন্ড একটা হুংকার। থরথর করে কেঁপে উঠল সমস্ত বন। গাছে গাছে নিশ্চিন্তে বসেছিল পাখিগুলো, তারা ভয়ে ডানা ঝাপটাতে শুরু করল। মাটির তলায় লুকিয়ে ছিল যে ইঁদুর, গুবরে পোকার দল-তারাও বুঝতে চাইল কী এমন ঘটল যে, এমন করে কেঁপে উঠল পৃথিবী?

হাতিটা এমন ভাব করতে শুরু করল, সেই বুঝি বনের রাজা। গুরুগম্ভীর ভারিক্কি চালের কেশর দোলানো প্রবল শক্তিধর সিংহ। সেও হাতিটার কাছে আসতে ভয় পায়। হালুম বাঘ মামা, সেও হাতিটার ধারে-কাছে ঘেঁষতে চায় না। বনের সবাই ভয়ে তটস্থ, শঙ্কিত। কখন জানি কী হয়!

একবার হাতিটা নিরীহ একটা হরিণকে শুঁড়ে জড়িয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে। আরেকবার ছোট্ট একটা খরগোশকে পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেলল। সেই থেকে বনের কোনো প্রাণী হাতিটার ছায়াও মাড়াত না। দিনে দিনে হাতিটা হয়ে উঠল আরও অহংকারী। এই নিয়ে বনের কারো মনে শান্তি নেই।

কিন্তু এভাবে কি দিন যায়? এক সন্ধ্যায় বনের সব প্রাণী এসে জড়ো হলো সিংহের গুহায়। এর একটা বিহিত চাই, সবার মুখে এক কথা। বাঘ, ভালুক, সিংহ, বানর, হরিণ, বনবিড়াল, শিয়াল সবাই সলা-পরামর্শ করতে বসল। শেষে সবাই মিলে শিয়ালের উপরেই ভার দিল হাতিকে সামলানোর।

তারপর একদিন শিয়াল ভয়ে ভয়ে হাজির হলো হাতির আস্তানায়। লেজ গুটিয়ে একটা সালাম দিল। বলল, আপনিই তো বনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী। আপনিই আমাদের রাজা। ওই দেখুন, নদীর ওপারে সবাই উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। তারা আপনাকে রাজা হিসেবে বরণ করে নিতে চায়।

হাতি তো শিয়ালের কথা শুনে মহাখুশি। ‘আচ্ছা চল’ বলে সে শিয়ালের সাথে হাঁটা শুরু করল।
নদীর পারে এসে শিয়াল বলল, এই আমি নদী সাঁতরে পার হচ্ছি। আপনিও আসুন।

এই বলে শিয়াল নদীতে দিল ঝাঁপ। হাতি ভাবল, পুঁচকে শিয়াল যদি নদী পার হতে পারে, আমি পারব না কেন? সেও নদীতে নেমে পড়ল।
হাতির মস্তবড়ো শরীর। ভীষণ ভারী। হাতিটা নদীর পানিতে যেই পা দিল, অমনি তার ভারী শরীর একটু একটু করে তলিয়ে যেতে থাকল। তলিয়ে যেতে যেতে হাতি বলল, শিয়াল ভায়া, আমাকে বাঁচাও।

শিয়াল ততক্ষণে নদী পার হয়ে তীরে উঠে গেছে।
শিয়াল হাতিকে বলল, তোমাকে বাঁচাব আমরা? এতদিন তোমার অত্যাচারে আমরা কেউ বনে শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। বনের যত প্রাণী ছিল, সবাই শিয়ালের কথার প্রতিধ্বনি করে সমম্বরে বলে উঠল:

ঠিক বলেছ শিয়াল ভায়া
দেখব না আর হাতির ছায়া
আমরা এখন মুক্ত-স্বাধীন
নাচছি সবাই তা-ধিন তা-ধিন।

(হিতোপদেশ অবলম্বনে)

error: Content is protected !!