আদিম যুগের মানুষ কৃষিকাজ জানত না। শিকা ও সংগ্রহ নির্ভর সমাজ ছিল। এরপর মানুষ আগুনের ব্যবহার আয়ত্ত করে। পাথর ভেঙে ধারালো অস্ত্র তৈরি করতে শেখে। পাথর যুগের এই সময়কে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যথাক্রমে পুরোনো পাথরের যুগ বা পুরোপলীয় যুগ, মধ্যপলীয় ও নবপলীয় যুগ। নবপলীয় যুগ শেষভাগে উদ্যান কৃষি, পশুপালন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে মানুষ আপাত স্থায়ী আবাসন গড়ে তুলেছিল। পরবর্তীকালে নদী অববাহিকায় কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠে। এভাবেই মানবসভ্যতার শুরু।
সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ধারায় মানুষ ধীরে ধীরে একটি জটিল সমাজব্যবস্থায় অভ্যন্ত হয়। উপযুক্ত নগরায়ন, স্থাপত্য, লিখন পদ্ধতি, জাতিসত্তার পরিচয়, সরকারব্যবস্থা, ধর্মীয় অনুশাসনসহ আরও নানা উৎকর্ষ মানুষ, যা তার সভ্যতা নামে পরিচিত তৈরি করেছে। প্রখ্যাত ইতিহাস গবেষক আর্নল্ড জোসেফ টয়েনবি তাঁর ‘এ স্টাডি অব হিস্ট্রি’ গ্রন্থে সভ্যতার উত্থানপর্বের নানা বিষয় সুস্পষ্ট করে লিখেছেন। তিনি মনে করেন বিশ্বসভ্যতার উদ্ভব হয়েছে বিভিন্নমুখী চ্যালেঞ্জ তথা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে গিয়ে। বিশ্বের নানা স্থানে বিকশিত সভ্যতা হিসেবে মেসোপটেমিয়া, সিন্ধু, মিসর, চিন, গ্রিক, রোম, মায়া, ইনকা কিংবা অ্যাজটেক সম্পর্কে আলোচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
Table of Contents
মেসোপটেমীয় সভ্যতা
‘মেসোপটেমিয়া’ এসেছে গ্রিক শব্দ মেসোস (Mesos) তথা ‘মধ্যবর্তী’ এবং পটামোস (Potamos) অর্থাৎ ‘নদী’ থেকে। সহজ বাংলায় বলতে পারি ‘মেসোপটেমিয়া’ অর্থ ‘দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূমি’ দজলা ফোরাত কিংবা টাইগ্রিস-ইউফ্রেতিস যাই বলা হোক, মেসোপটেমিয়া সভ্যতার বিস্তার দুটি নদীর মাঝখানে অবস্থিত পলল বিধৌত উর্বর ভূমিতে। মানচিত্রের মাঝে এই উর্বর ভূমিরূপকে দেখাতো অনেকটাই অর্ধচন্দ্র তথা বাঁকানো চাঁদের মতো। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফার্টাইল ক্রিসেন্ট’। মূলত ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন আর জর্দান মিলেই এই ফার্টাইল ক্রিসেন্টের বিস্তার। অনেকে কুয়েতের উত্তরাংশ এবং তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাংশের পাশাপাশি ইরানের পশ্চিম দিকের একাংশকে এই উর্বর অর্ধচন্দ্রাকৃতির ভূমিরূপ তথা ফার্টাইল ক্রিসেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
মূলত সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, এসেরীয় এবং ক্যালডীয় সভ্যতার সম্মিলিত রূপকেই আমরা জেনে থাকি মেসোপটেমীয় সভ্যতা হিসেবে। এই সভ্যতা শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দের দিকে। বর্তমান ইরাক থেকে শুরু করে ফার্টাইল ক্রিসেটের প্রায় পুরোটা ছিল এই সভ্যতার বিস্তার। এই সভ্যতার বিকাশ যে অঞ্চলে ঘটেছিল তার উত্তরে আর্মেনিয়ার পার্বত্যাঞ্চল, পশ্চিম ও দক্ষিণে আরব মরুভূমি, দক্ষিণ-পূর্বে পারস্য উপসাগর, পূর্বে এলাম পার্বত্যাঞ্চল এবং পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর অবস্থিত। উত্তর ও পূর্বদিকে উচ্চ পার্বত্যাঞ্চল মেসোপটেমিয়াকে প্রাকৃতিক প্রাচীরের সুবিধা দিয়েছে। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সুমেরীয়, আক্কাদীয়, আমোরাইট, ক্যাসাইট, এসেরীয় এবং ক্যালডীয় জাতিগোষ্ঠী মিলে প্রাচীনকালে এই ভূখণ্ডে একটি উন্নত সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। কৃষির জন্য সেচ আর যাতায়াতের ক্ষেত্রে চাকার আবিষ্কার ছিল এই সভ্যতার জন্য যুগান্তকারী অর্জন।
এই অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলায় প্রথম নেতৃত্ব দিয়েছিল সুমেরীয়রা। পুরাতাত্ত্বিক খনন করে মেসোপটেমিয়ার ইউবেইদ অঞ্চলে কয়েকটি জনবসতি পাওয়া গিয়েছে। ইউবেইদের মতো ওয়ারকা সংস্কৃতি সুমেরীয় ভাষায় ইউরুক (Uruk) ও সেমেটিক ভাষায় ইরেচ (Erech) নামে পরিচিত। এই সংস্কৃতি আদি সাক্ষরতা যুগের (Protoliterate) মেসোপটেমিয়ার কথা জানান দিচ্ছে। প্রাথমিক যুগের সংস্কৃতি হিসেবে এই ওয়ারকাতে উন্নতমানের মৃৎপাত্র তৈরির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ইয়াননায় অবস্থিত দেবতা আনুর (Anu) মন্দির এবং ইউরুক এর জিগুরাট তথা শ্বেত মন্দির এই সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শন।
দজলা ফোরাত নদীর তীরে মেসোপটেমীয় সভ্যতার প্রাথমিক বিকাশের সময়কাল হিসেবে মনে করা হয় ৩৫০০-৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দকে। তখন এই অঞ্চলের নিচু সমতলে প্রথম সংস্কৃতির চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। ধারণা করা হয় ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের শেষদিকে কয়েকটি জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলে বসতি গড়ে তুলেছিল। প্রাথমিক দিকের মেসোপটেমিয়াতে গড়ে উঠেছিল কিছু নগররাষ্ট্র। যেমন-উর, ইউরুক, লাগাশ, উম্মা প্রভৃতি। প্রাচীন গ্রামসমূহের চেয়ে আকারে বেশ বড় ছিল এই নগররাষ্ট্রগুলোর। পাশাপাশি এখানে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডের কেন্দ্রভূমিও গড়ে উঠেছিল।
সভ্যতার মূল অর্জনসমূহ
সভ্যতার উন্মেষপর্ব হিসেবে মনে করা যেতে পারে ৩০০০ খিষ্টপূর্বাব্দ সময়কালকে। এই সময়ের শেষ দিকে মেসোপটেমীয়রা টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস নদীর পানিকে বাঁধ দিয়ে কৃষিকাজের প্রয়োজনে সেচের জন্য ব্যবহার করতে থাকে। তারা প্রচুর খাল খননের মাধ্যমে বন্যা প্রতিরোধ করতে পেরেছিল। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার মূল আবিষ্কারের একটি ছিল চাকা। তারা চাকার ব্যবহার আয়ত্ব করার সেখানে ফসলের গাড়ি চলার জন্য রাস্তা তৈরি করতে হয়েছিল। নগরের মধ্যে নির্মিত বেশিরভাগ রাস্তা ছিল প্রশস্ত।
কৃষি ও পশুপালন
এ অঞ্চলের কৃষকরা কাঠের লাঙল ও পাথরের কুঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। তাদের প্রধান উৎপাদিত ফসল ছিল যব। গৃহপালিত পশুর মধ্যে সিংহভাগ ছিল ভেড়া ও ছাগল। তবে পশুপালনের সময় নিরাপত্তাজনিত কারণে রাখালরা অনেক সময় কুকুর ব্যবহার করত। মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে মাটির দেওয়াল বা খেজুরগাছের বেষ্টনি দিয়ে তার ভেতরে বাগান তৈরি করা হতো। মূলত বাইরের তৃণভোজী জন্তু থেকে তারা এই বাগানকে নিরাপদ রাখতে চেয়েছিল। এসব বাগানে মেসোপটেমীয় অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন ফলের গাছ রোপণ করেছিল বলে জানা গিয়েছে। কৃষিজমি তথা ফসলের মাঠ থেকে বিভিন্ন শহরে ফসল পরিবহণের জন্য স্থলপথে গাধা ছিল তাদের মূল বাহন। তবে পানিপথে তারা নৌকার মতো ছোট-বড় ভেলা ব্যবহার করত।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
গণিতের উদ্ভাবন ও উন্নয়নের মেসোপটেমিয়া সভ্যতার বিশেষ গুরুত্ব ছিল। পুরোহিতরা ফসল জমা নেওয়ার পর মন্দিরের দেওয়ালের গায়ে দাগ কেটে তার হিসেব রাখত। তাদের সংখ্যাগুলি ষষ্ঠিক বা ষাট কেন্দ্রিক ছিল। তারা সেখান থেকেই এক ঘণ্টায় ষাট মিনিট ও এক মিনিটে ষাট সেকেন্ডের হিসাব শুরু করেছিল। বছরকে ১২ মাসে এবং এক মাসকে ৩০ দিনে ভাগ করে হিসাব করা শুরু করেছিল তারাই। পৃথিবীকে ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করার পাশাপাশি রাশিচক্রের হিসেব তারাই শুরু করেছিল। ব্রোঞ্জ আবিষ্কারের পাশাপাশি আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে তারা কাচের ব্যবহার শুরু করেছিল।
ভাষা ও সাহিত্য
মেসোপটেমিয়ার মানুষ সেমিটিক ভাষা ব্যবহার করত। তাদের এ ভাষায় ভাবের আদান-প্রদানের পাশাপাশি প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ড চলত। এ ভাষার জন্য তারা কিছু অর্থবোধক ছবির মাধ্যমে একটি আদিম লেখন পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিল। চিত্রধর্মী এই পদ্ধতিতে কাদামাটির উপর নলখাগড়ার সূঁচালো মাথা দিয়ে লিখে তারা তা শুকিয়ে নিত। আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বের লিখিত বর্ণমালার দলিল পাওয়া গিয়েছে মেসোপটেমীয় থেকে। তারা তাদের নিজস্ব ভাষায় গিলগামেশ নামের মহাকাব্য রচনা করেছিল।
নগর
নদীর তীরে অবস্থিত মেসোপটেমিয়ার সিংহভাগ শহরের কেন্দ্র ছিল দুর্গবেষ্টিত। দুর্গের দেওয়াল ছিল রোদে শুকানো ইট দ্বারা নির্মিত। এই ইটগুলো পোড়ানোর ক্ষমতা তখনও আয়ত্বে আসেনি তাদের। বিশেষত, ইউরুক শহরে ৬ মাইল দীর্ঘ দুর্গ ঘেরা একটি অঞ্চল আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা কিংবদন্তির বীর রাজা গিলগামেশ এই দুর্গ নির্মাণ করেছিল। এই সময়ে নির্মিত বেশির ভাগ নগরে নগর-তোরণ ছিল। প্রতিটি তোরণের সামনে শক্তিশালী সেনাবাহিনী পাহারা দিত।
আইন ও বিচার
পারস্যের সিপার দুর্গে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে একটি কালো-সবুজ পাথরের তৈরি স্মৃতিস্তম্ভ। এই পাথরে সংকলিত হয়েছে প্রখ্যাত হাম্বুরাবির আইন। বর্তমানে পাথরের স্তম্ভটি প্যারিসের ল্যুভ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ৮ ফুট উঁচু এই পাথরের উপরের অংশে রয়েছে একটি ভাস্কর্য। এই পাথরের নিচের দিকে লেখা হয়েছে ২৮২টি আইনের ধারা। দেশে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দুষ্ট এবং অসৎ লোকদের ধ্বংস করে দুর্বলকে রক্ষা করার প্রয়োজনে এই আইন প্রবর্তন করা হয়েছিল।
ধর্ম
প্রাচীন মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের মানুষের প্রাথমিক ধর্মবিশ্বাস ছিল ঐহিক তথা পার্থিব। মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের তেমন ধারণা ছিল না। পরকালের জীবনকে গুরুত্ব দেয়নি বলেই মৃতদেহের সমাধি প্রথা ছিল সাদামাটা। সুমেরীয় ধর্মে নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিকতা কোনোটাই বিশেষ স্থান পায়নি। তারা জীবনমুখী একটি সহজবোধ্য ধর্মের অনুসারী ছিল বলে অনুমান করা হয়ে থাকে। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রমাণ হিসেবে পাওয়া গিয়েছে শহর সংলগ্ন দেবমন্দির। পাহাড়সদৃশ সিঁড়ির ধাপ কেটে তৈরি এই মন্দিরগুলোকে বলা হতো জিগুরাত (Ziggurat)।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার মানুষ সূর্য দেবতা শামাশ; বৃষ্টি, বাতাস ও বন্যার দেবতা এনলিল; পানির দেবতা এনকি; প্রেমের উর্বরতার দেবী ইনাননা তথা ইশতার, প্লেগ রোগের দেবতা নারগলের আরাধনা করেছে। দেব-দেবীর উদ্দেশে এরা তেল, মাখন, শাকসবজি, ফল, ফুল, খাদ্য প্রভৃতি উৎসর্গ করত। তাদের প্রধান ধর্মমন্দির জিগুরাতে থাকতেন তাদের পুরোহিত রাজা। ওখানে থেকে তিনি ‘পাতেজী’ ধর্ম পরিচালনা করতেন।
রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য
বিভিন্ন সময় বহিঃশক্তি এই সভ্যতাকে আক্রমণ করে পর্যুদন্ত করেছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের মধ্য দিয়ে এর রাজনৈতিক ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে। তাই এই অঞ্চলের জাতিসত্তা ছিল বিভিন্ন জাতির মিশ্রণে গড়া। এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন গড়ে উঠেছিল সময় ও স্থানভিত্তিতে একটু আলাদা ধারায়।
সিন্ধুসভ্যতা
পটভূমি: সিন্ধু নদের অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল বলে এই সভ্যতার নাম রাখা হয় সিন্ধুসভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার সংস্কৃতিকে অনেক সময়ে হরপ্পা সংস্কৃতি বা হরপ্পা সভ্যতা বলা হয়ে থাকে। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদারো শহরে উঁচু উঁচু মাটির ঢিবি ছিল। স্থানীয় লোকেরা বলত মরা মানুষের ঢিবি (মহেঞ্জোদারো কথাটির মানেও তাই)। বাঙালি পুরাতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপধ্যায়ের নেতৃত্বে পুরাতত্ত্ব বিভাগের লোকেরা ঐ স্থানে বৌদ্ধস্তূপের ধ্বংসাবশেষ আছে ভেবে মাটি খুঁড়তে থাকেন। অপ্রত্যাশিতভাবে বেরিয়ে আসে তাম্রযুগের নিদর্শন। একই সময়ে ১৯২২-২৩ খ্রিষ্টাব্দে দয়ারাম সাহানীর প্রচেষ্টায় পাঞ্জাবের পশ্চিম দিকে মন্টোগোমারি জেলার হরপ্পা নামক স্থানেও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। জন মার্শালের নেতৃত্বে পুরাতত্ত্ব বিভাগ অনুসন্ধান চালিয়ে আরও বহু নিদর্শন আবিষ্কার করে।
ভৌগোলিক অবস্থান: উপমহাদেশের প্রাচীনতম সিন্ধুসভ্যতার বিস্তৃতি বিশাল এলাকাজুড়ে। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পাতে এই সভ্যতার নিদর্শন সবচেয়ে বেশি আবিষ্কৃত হয়েছে। তা সত্ত্বেও ঐ সভ্যতা শুধু সিন্ধু অববাহিকা বা ঐ দুটি শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধু প্রদেশ, ভারতের পাঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাটের বিভিন্ন অংশে এই সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, পাঞ্জাব থেকে আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভৌগোলিক এলাকা জুড়ে সিন্ধুসভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
সময়কাল: সিন্ধুসভ্যতার সময়কাল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, ৩৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এ সভ্যতার উত্থান-পতনের কাল। আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, আর্য জাতির আক্রমণের ফলে খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ১৫০০ অথবা ১৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সিন্ধুসভ্যতার অবসান ঘটে। তবে মর্টিমার হুইলার মনে করেন, এই সভ্যতার সময়কাল হচ্ছে ২৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত।
রাজনৈতিক অবস্থা: সিন্ধুসভ্যতার জনগণের রাজনৈতিক জীবন ও শাসনপ্রণালি সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার নগর বিন্যাস প্রায় একই রকম ছিল। এগুলোর ধ্বংসাবশেষ দেখে নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় যে, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী উঁচু ভিতের উপর শহরগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। শহরগুলোর এক পাশে উঁচু ভিত্তির উপর একটি করে নগরদুর্গ নির্মাণ করা হতো। চারদিক থাকত প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত। নগরের শাসনকর্তারা নগর দুর্গে বসবাস করতেন। প্রশাসনিক বাড়িঘরও দুর্গের মধ্যে ছিল। নগরের ছিল প্রবেশদ্বার। দুর্গ বা বিরাট অট্টালিকা দেখে মনে হয় একই ধরনের কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে নগর দুটিতে প্রচলিত ছিল। এই প্রশাসন জনগণের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করত।
সামাজিক অবস্থা: সিন্ধুসভ্যতার যুগে মানুষ সমাজবদ্ধ পরিবেশে বসবাস করত। সেখানে একক পরিবার পদ্ধতি চালু ছিল। সিন্ধুসভ্যতার যুগে সমাজে শ্রেণিবিভাগ ছিল। সব লোক সমান সুযোগ-সুবিধা পেত না। সমাজ ধনী ও দরিদ্র দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। কৃষকরা গ্রামে বসবাস করত। শহরে ধনী এবং শ্রমিকদের জন্য আলাদা-আলাদা বাসস্থানের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
পোশাক-পরিচ্ছদের জন্য তারা মূলত সুতা ও পশম ব্যবহার করত। সিন্ধুসভ্যতার সমাজব্যবস্থা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। নারীরা খুবই শৌখিন ছিল। তাদের প্রিয় অলংকারের মধ্যে ছিল হার, আংটি, দুল, বিছা, বাজুবন্ধ, চুড়ি, বালা, পায়ের মল ইত্যাদি। তারা নকশা করা দীর্ঘ পোশাক পরত। পুরুষরাও অলংকার ব্যবহার করত।
অর্থনৈতিক অবস্থা: সিন্ধুসভ্যতার অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষিনির্ভর। তাছাড়াও অর্থনীতির আর একটি বড়
দিক ছিল পশুপালন। কৃষি ও পশুপালনের পাশাপাশি মৃৎপাত্র নির্মাণ, ধাতুশিল্প, বয়নশিল্প, অলংকার নির্মাণ, পাথরের কাজ ইত্যাদিতেও তারা যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছিল। এই উন্নতমানের শিল্পপণ্য বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে সেখানকার বণিকরা বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলত। বণিকদের সাথে আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, মধ্য এশিয়া, পারস্য, মেসোপটেমিয়া, দক্ষিণ ভারত, রাজপুতনা, গুজরাট প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল।
ধর্মীয় অবস্থা: সিন্ধুসভ্যতায় কোনো মন্দির বা মঠের চিহ্ন পাওয়া যায়নি; যে কারণে তাদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করা সম্ভব নয়। মন্দির বা উপাসনা গৃহের অস্তিত্ব না থাকলেও স্থানে স্থানে অসংখ্য পোড়ামাটির নারীমূর্তি পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, তারা ঐ ধরনের দেবীমূর্তির পূজা করত। সিন্ধুবাসীর মধ্যে মাতৃপূজা খুব জনপ্রিয় ছিল। তাছাড়া তারা দেব-দেবী মনে করে বৃক্ষ, পাথর, সাপ এবং পশু-পাখির উপাসনাও করত। সিন্ধুবাসী পরলোকে বিশ্বাস করত। যে কারণে কবরে মৃতের ব্যবহার করা জিনিসপত্র ও অলঙ্কার রেখে দিত।
সিন্ধুসভ্যতার অবদান: পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিন্ধুসভ্যতা। নিম্নে এই সভ্যতার অবদান আলোচনা করা হলো।
নগর পরিকল্পনা: সিন্ধুসভ্যতার এলাকায় যেসব শহর আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সবচেয়ে বড় শহর। ঘরবাড়ি সবই পোড়ামাটি বা রোদে পোড়ানো ইট দিয়ে তৈরি। শহরগুলোর বাড়িঘরের নকশা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, সিন্ধুসভ্যতা যুগের অধিবাসীরা উন্নত নগরকেন্দ্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর নগর পরিকল্পনা একই রকম ছিল। নগরীর ভেতর দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। রাস্তাগুলো ছিল সোজা। প্রত্যেকটি বাড়িতে খোলা জায়গা, কূপ ও স্নানাগার ছিল। পানি নিষ্কাশনের জন্যে ছোট নর্দমাগুলোকে মূল নর্দমার সাথে সংযুক্ত করা হতো। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হতো। পথের ধারে ছিল সারিবদ্ধ ল্যাম্পপোস্ট।
পরিমাপ পদ্ধতি: সিন্ধুসভ্যতা যুগের অধিবাসীরা দ্রব্যের ওজন পরিমাপ করতে শিখেছিল। তাদের এই পরিমাপ পদ্ধতির আবিষ্কার সভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে বিবেচিত। তারা বিভিন্ন দ্রব্য ওজনের জন্য নানা মাপের ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির বাটখারা ব্যবহার করত। দাগ কাটা স্কেল দিয়ে দৈর্ঘ্য মাপার পদ্ধতিও তাদের জানা ছিল।
শিল্প: সিন্ধুসভ্যতা যুগের অধিবাসীদের শিল্পবোধ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই মৃৎশিল্পের কথা বলতে হয়। তারা কুমারের চাকার ব্যবহার জানত এবং তার সাহায্যে সুন্দর মাটির পাত্র বানাতে পারত। পাত্রগুলোর গায়ে অনেক সময় সুন্দর সুন্দর নকশা আঁকা থাকত। তাঁতিরা বয়নশিল্পে পারদর্শী ছিল। ধাতুর সাহায্যে আসবাবপত্র, অস্ত্র এবং অলংকার তৈরি করা হতো। তারা তামা ও টিনের মিশ্রণে ব্রোঞ্জ তৈরি করতে শিখেছিল। কারিগররা রুপা, তামা, ব্রোঞ্জ প্রভৃতি দ্বারা তৈজসপত্র তৈরি করত। তাছাড়া সোনা, রুপা, তামা, ইলক্ট্রাম ও ব্রোঞ্জ ইত্যাদি ধাতুর অলংকার তৈরিতে তারা পারদর্শী ছিল। অলংকারের মধ্যে আংটি, বালা, নাকফুল, গলার হার, কানের দুল, বাজুবন্ধ ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য। সিন্ধুসভ্যতা যুগের অধিবাসীরা লোহার ব্যবহার জানত না। তারা ধাতু ছাড়া দামি পাথরের সাহায্যে অলংকারও তৈরি করতে পারত। হাতির দাঁতসহ অন্যান্য হস্তশিল্পেরও দক্ষ কারিগর ছিল।
স্থাপত্য ও ভাস্কর্য: সিন্ধুসভ্যতা যুগের অধিবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ এবং চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন রেখে গেছে। সেখানে দুই কক্ষ থেকে পঁচিশ কক্ষের বাড়ির সন্ধানও পাওয়া গেছে। আবার কোথাও দুই-তিন তলা ঘরের অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়েছে। মহেঞ্জোদারোর স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ‘বৃহৎ মিলনায়তন’ যা ৮০ ফুট জায়গাজুড়ে তৈরি হয়েছিল। তাছাড়া বিশাল এক প্রাসাদের সন্ধান পাওয়া গেছে। হরপ্পাতে বিরাট আকারের শস্যাগারও পাওয়া গেছে। মহেঞ্জোদারোতে একটি ‘বৃহৎ স্নানাগার’-এর নিদর্শন পাওয়া গেছে যার মাঝখানে বিশাল চৌবাচ্চাটি ছিল সাঁতার কাটার উপযোগী।
ভাস্কর্যশিল্পেও সিন্ধুসভ্যতা যুগের অধিবাসীদের দক্ষতা ছিল। পাথরে খোদিত ভাস্কর্যের সংখ্যা কম হলেও সেগুলোর শৈল্পিক ও কারিগরি দক্ষতা ছিল উল্লেখ করার মতো। এ যুগে মোট ১৩টি ভাস্কর্য মূর্তি পাওয়া গেছে। চুনাপাথরে তৈরি একটি মূর্তির মাথা পাওয়া গেছে। মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া গেছে নৃত্যরত একটি নারীমূর্তি। এছাড়া মাটির তৈরি ছোট ছোট মানুষ আর পশুমূর্তিও পাওয়া গেছে। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম হলো বিভিন্ন ধরনের প্রায় ২৫০০ সিল। ধর্মীয় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে এগুলো ব্যবহৃত হতো।
মিশরীয় সভ্যতা
পটভূমি: আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত দেশটির নাম ইজিপ্ট বা মিশর। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৩২০০ অব্দ পর্যন্ত নীল নদের অববাহিকায় একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার উদ্ভব হয়, যা মিশরীয় সভ্যতা নামে পরিচিত। এ সময় থেকে মিশর প্রাচীন সভ্যতায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে শুরু করে। ৩২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে প্রথম রাজবংশের শাসন আমল শুরু হয়। এ সময় থেকে মিশরের ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। একই সময়ে নারমার বা মেনেস হন একাধারে মিশরের প্রথম নরপতি ও পুরোহিত। তিনি প্রথম ফারাও-এর মর্যাদাও লাভ করেন। এরপর থেকে ফারাওদের অধীনে মিশর প্রাচীন বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতিতে একের পর এক উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
ভৌগোলিক অবস্থান: তিনটি মহাদেশ দ্বারা ঘিরে থাকা মিশরের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশটি এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত। এর উত্তরে ভূমধ্যসাগর, পূর্বে লোহিত সাগর, পশ্চিমে সাহারা মরুভূমি, দক্ষিণে সুদান ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশ। এর মোট আয়তন প্রায় চার লক্ষ বর্গমাইল।
সময়কাল: মিশরীয় সভ্যতা ২৫০০ বছরেরও বেশি সময়ব্যাপী স্থায়ী হয়েছিল। প্রাচীন মিশরের নিরবচ্ছিন্ন ও দীর্ঘ ইতিহাসের সূচনা হয় ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। বিশেষ করে নবোপলীয় যুগে। তবে মিশরীয় সভ্যতার গোড়াপত্তন হয় মেনেসের নেতৃত্বে, যা প্রায় তিন হাজার বছর ধরে স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব দশম শতকে লিবিয়ার এক যোদ্ধা জাতি ফারাওদের সিংহাসন দখল করে নেয়। ৬৭০-৬৬২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অ্যাসিরীয়রা মিশরে আধিপত্য বিস্তার করে। ৫২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পারস্য মিশর দখল করে নিলে প্রাচীন মিশরের সভ্যতার সূর্য অস্তমিত হয়।
রাষ্ট্র ও সমাজ: প্রাক-রাজবংশীয় যুগে মিশর কতকগুলো ছোট নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। এগুলোকে ‘নোম’ বলা হতো। মিশরের প্রথম রাজা বা ফারাও (মেনেস বা নারমার) সমগ্র মিশরকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে ঐক্যবদ্ধ করে একটি রাজ্য গড়ে তোলেন, যার রাজধানী ছিল দক্ষিণ মিশরের মেক্ষিসে। তখন থেকে মিশরে ঐক্যবদ্ধ রাজ্য ও রাজবংশের উদ্ভব। মিশরীয় ‘পের-ও’ শব্দ থেকে ফারাও শব্দের জন্ম। ফারাওরা ছিল অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। তারা নিজেদের সূর্য দেবতার বংশধর মনে করত। ফারাও পদটি ছিল বংশানুক্রমিক। অর্থাৎ ফারাওয়ের ছেলে হতো উত্তরাধিকারসূত্রে ফারাও।
পেশার ওপর ভিত্তি করে মিশরীয়দের কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন- রাজপরিবার, পুরোহিত, অভিজাত, লিপিকার, ব্যবসায়ী, শিল্পী এবং কৃষক ও ভূমিদাস শ্রেণি।
মিশরের অর্থনীতি মূলত ছিল কৃষিনির্ভর। উৎপাদিত ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গম, যব, তুলা, পেঁয়াজ, পিচফল ইত্যাদি। ব্যবসা-বাণিজ্যেও মিশর ছিল অগ্রগামী। মিশরে উৎপাদিত গম, লিনেন কাপড় ও মাটির পাত্র ক্রিট দ্বীপ, ফিনিশিয়া, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় রপ্তানি হতো। বিভিন্ন দেশ থেকে মিশরীয়রা স্বর্ণ, রৌপ্য, হাতির দাঁত, কাঠ ইত্যাদি আমদানি করত।
নীল নদ: মিশরের নীল নদের উৎপত্তি আফ্রিকার লেক ভিক্টোরিয়া থেকে। সেখান থেকে নদটি নানা দেশ হয়ে মিশরের মধ্য দিয়ে ভূ-মধ্যসাগরে এসে পড়েছে। ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস যথার্থই বলেছেন- ‘মিশর নীল নদের দান’। নীল নদ না থাকলে মিশর মরুভূমিতে পরিণত হতো। প্রাচীনকালে প্রতিবছর নীল নদে বন্যা হতো। বন্যার পর পানি সরে গেলে দুই তীরে পলিমাটি পড়ে জমি উর্বর হতো। জমে থাকা পলিমাটিতে জন্মাতো নানা ধরনের ফসল।
সভ্যতায় মিশরীয়দের অবদান: প্রাচীন সভ্যতায় মিশরীয়দের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ধর্মীয় চিন্তা, শিল্প, ভাস্কর্য, লিখন পদ্ধতি, কাগজের আবিষ্কার, জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা-সবকিছুই তাদের অবদানে সমৃদ্ধ। মিশরীয়দের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, তাদের জীবন ধর্মীয় চিন্তা ও বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
মিশরীয়দের ধর্মবিশ্বাস: সম্ভবত প্রাচীন মিশরীয়দের মতো অন্য কোনো জাতি জীবনের সকল ক্ষেত্রে এতটা ধর্মীয় নিয়ম-কানুন অনুশাসন দ্বারা প্রভাবিত ছিল না। সে কারণে মানবসভ্যতার অনেক ধ্যানধারণা, রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠানের জন্ম প্রাচীন মিশরে। তারা জড়বস্তুর পূজা করত, মূর্তিপূজা করত, আবার জীবজন্তুর পূজাও করত। বিভিন্ন সময়ে তাদের ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটেছে। মিশরীয়দের ধারণা ছিল-সূর্যদেবতা ‘রে’ বা ‘আমন রে’ এবং প্রাকৃতিক শক্তি, শস্য ও নীল নদের দেবতা ‘ওসিরিস’ মিলিতভাবে সমগ্র পৃথিবী পরিচালিত করেন। তবে, তাদের জীবনে সূর্যদেবতা ‘রে’-এর গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি।
মিশরীয়রা মনে করত মৃত ব্যক্তি আবার একদিন বেঁচে উঠবে। সে কারণে দেহকে তাজা রাখার জন্য তারা মমি করে রাখত। এই চিন্তা থেকে মমিকে রক্ষার জন্য তারা পিরামিড তৈরি করেছিল। ফারাওরা স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করত। তারা ছিল প্রধান পুরোহিত এবং অন্যান্য পুরোহিতকেও তারা নিয়োগ করত।
শিল্প: মিশরীয়দের চিত্রকলা বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য দেশের মতো চিত্রশিল্পও গড়ে উঠেছিল ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। তারা সমাধি আর মন্দিরের দেয়াল সাজাতে গিয়ে চিত্রশিল্পের সূচনা করে। তাদের প্রিয় রং ছিল সাদা-কালো। সমাধি, পিরামিড, মন্দির, প্রাসাদ, প্রমোদ কানন, সাধারণ ঘর-বাড়ির দেয়ালে মিশরীয় চিত্রশিল্পীরা অসাধারণ ছবি এঁকেছেন। সেসব ছবির মধ্যে সমসাময়িক মিশরের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কাহিনি ফুটে উঠেছে।
কারুশিল্পেও প্রাচীন মিশরীয় শিল্পীরা অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। আসবাবপত্র, মৃৎপাত্র, সোনা, রুপা, মূল্যবান পাথরে খচিত তৈজসপত্র, অলঙ্কার, মমির মুখোশ, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, হাতির দাঁত ও ধাতুর দ্রব্যাদি মিশরীয় কারু শিল্পের দক্ষতার প্রমাণ বহন করে।
ভাস্কর্য: ভাস্কর্য শিল্পে মিশরীয়দের মতো প্রতিভার ছাপ আর কেউ রাখতে সক্ষম হয়নি। ব্যাপকতা, বৈচিত্র্য এবং ধর্মীয় ভাবধারায় প্রভাবিত বিশাল আকারের পাথরের মূর্তিগুলো ভাস্কর্য শিল্পে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। প্রতিটি ভাস্কর্য ধর্মীয় ভাবধারা, আচার অনুষ্ঠান, মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। প্রতিটি শিল্পই ছিল আসলে ধর্মীয় শিল্পকলা। সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য হচ্ছে গিজার অতুলনীয় স্ফিংক্স। স্ফিংক্স হচ্ছে এমন একটি মূর্তি, যার দেহ সিংহের মতো, কিন্তু মুখ মানুষের মতো। মিশরের সবচেয়ে বড় পিরামিড হচ্ছে ফারাও খুফুর পিরামিড। মন্দিরগুলোতে মিশরীয় ভাস্কর্য স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে।
লিখনপদ্ধতি ও কাগজ আবিষ্কার : মিশরীয় সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল লিপি বা অক্ষর আবিষ্কার। নগরসভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মিশরীয় লিখনপদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। পাঁচ হাজার বছর পূর্বে তারা সর্বপ্রথম ২৪টি ব্যঞ্জনবর্ণের বর্ণমালা আবিষ্কার করে। প্রথম দিকে ছবি এঁকে তারা মনের ভাব প্রকাশ করত। এই লিখনপদ্ধতির নাম ছিল চিত্রলিপি।
এই চিত্রলিপিকে বলা হয় ‘হায়ারোগ্লিফিক’ বা পবিত্র অক্ষর। মিশরীয়রা নলখাগড়া জাতীয় গাছের কাণ্ড থেকে কাগজ বানাতে শেখে। সেই কাগজের ওপর তারা লিখত। গ্রিকরা এই কাগজের নাম দেয় ‘প্যাপিরাস’। এই শব্দ থেকে ইংরেজি পেপার শব্দের উৎপত্তি। এখানে উল্লেখ্য, নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মিশর জয়ের সময় একটি পাথর আবিষ্কৃত হয় যা রসেটা স্টোন নামে পরিচিত। যাতে গ্রিক এবং’ হায়ারোগ্লিফিক’ ভাষায় অনেক লেখা ছিল, যা থেকে প্রাচীন মিশরের অনেক তথ্য জানা যায়।
বিজ্ঞান: মিশরীয় সভ্যতা ছিল কৃষিনির্ভর। সে কারণে নীল নদের প্লাবন, নাব্য, পানিপ্রবাহের মাপ জোয়ার-ভাটা ইত্যাদি ছাড়াও জমির মাপ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এসবের সঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্র ও অঙ্কশাস্ত্রের ছিল গভীর যোগাযোগ। ফলে এ দুইটি বিদ্যা তারা আয়ত্ত করেছিল। তারা অঙ্কশাস্ত্রের দুইটি শাখা জ্যামিতি এবং পাটিগণিতেরও প্রচলন করে। মিশরীয় সভ্যতার মানুষ যোগ, বিয়োগ ও ভাগের ব্যবহার জানত। ৪২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ তারা প্রথম সৌর পঞ্জিকা আবিষ্কার করে। ৩৬৫ দিনে বছর এ হিসাবের আবিষ্কারকও তারা। প্রাচীন মিশরের অধিবাসীরা সময় নির্ধারণের জন্য সূর্যঘড়ি, ছায়াঘড়ি, পানিঘড়ি আবিষ্কার করে।
ধর্মের কারণে মিশরীয়রা বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহী ছিল। তারা পরলোকে বিশ্বাস করত এবং ফারাওরা পরবর্তী জন্মেও রাজা হবেন এই বিশ্বাস তাদের ছিল। তাই তারা ফারাওদের দেহ তাজা রাখার পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এ কারণেই মমি তৈরি শুরু হয়। মিশরীয় বিজ্ঞানীরা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মৃতদেহ পচন থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হন।
চিকিৎসাশাস্ত্রেও প্রাচীন মিশরীয়রা বিশেষ অগ্রগতি লাভ করেছিল। তারা চোখ, দাঁত, পেটের রোগ নির্ণয় করতে জানত। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা করার বিদ্যাও তাদের জানা ছিল। তারা হাড় জোড়া লাগানো, হৃৎপিণ্ডের গতি এবং নাড়ির স্পন্দন নির্ণয় করতে পারত।
মিশরীয়রা দর্শন ও সাহিত্যচর্চা করত। তাদের রচনায় দুঃখ-হতাশার কোনো প্রকাশ ছিল না। তারা আশাবাদী ছিল। তাদের লেখায় সব সময়ই আনন্দের প্রকাশ দেখা গেছে।
চৈনিক সভ্যতা
ভৌগোলিক দিক থেকে দেখলে চীন দেশটির পাঁচ ভাগের প্রায় চার ভাগই জুড়ে আছে বিস্তৃত পাহাড়, পর্বত এবং মালভূমিতে। প্রাচীন চীন সভ্যতা মূলত দুটি বিশেষ রাজবংশীয় শাসনামলের অর্জন। ‘শাং’ এবং ‘চৌ’ যুগের কিছু অর্জনকে আলাদাভাবে তুলে ধরতে পারলেই একঅর্থে প্রাচীন সম্পর্কে আপাত কিছু ধারণা অর্জন করা যেতে পারে। তবে প্রাচীন চৈনিক সভ্যতা দীর্ঘকাল কৃতিত্বের সঙ্গে টিকে থাকার মূল কারণ একাধারে ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক।
বস্তুত চীন ভৌগোলিকভাবে অন্য যেকোনো দেশের থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এলাকা হলেও নানা দিক থেকে তারা ছিল বেশ সমৃদ্ধ। ফলে খাবার ও বাসস্থান সংকটে চীনাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগ দিতে হয়নি। ভৌগোলিক অবস্থানগতভাবে চীনের সঙ্গে যুক্ত ছিল পার্শ্ববর্তী তিব্বত, সিংকিয়াং, মঙ্গোলিয়া এবং মাঞ্চুরিয়া। বিবর্তনবাদী ইতিহাস গবেষকরা পিকিংম্যান (Sinanthropus Pekinesis) দের দেহাবশেষ প্রাপ্তিকাল থেকে চৈনিক ইতিহাস ও সভ্যতার আলোচনা শুরু করেন।
প্রাচীন চীনে তিনটি অঞ্চল ঘিরে সভ্যতাটি গড়ে উঠেছিল যার কেন্দ্র ছিল পশ্চিমের উচ্চভূমি হতে উৎপন্ন নদীসমূহ। প্রথম সভ্যতা গড়ে ওঠে হোয়াং হো তীরবর্তী অঞ্চলে, দ্বিতীয়টি ইয়াংজেকিয়াং তীরবর্তী অঞ্চলে এবং তৃতীয়টি দক্ষিণ চীনের সুবিস্তৃত ভূখণ্ডে।
হোয়াংহো নদীর ধীর প্রবাহ এর দুতীরে বিস্তীর্ণ পলল ভূমির সৃষ্টি করেছে। তবে বর্ষায় দু-কূল ছাপিয়ে আসা বন্যায় জীবন ও ফসল অনেক সময় ধ্বংস হতো। আর এজন্যই ইতিহাসে হোয়াংহো পরিচয় তৈরি করেছে ‘চীনের দুঃখ’। চীনের দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত ইয়াংজেকিয়াং বিশ্বের অন্যতম বড় নদী। দক্ষিণ চীনের পাহাড়ি অঞ্চল ছিল খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। দক্ষিণে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর গড়ে ওঠায় তা বৈদেশিক বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়।
অন্য সব সভ্যতা থেকে আপাত বিচ্ছিন্ন বলে চীনের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলোকেও সহজে অন্যদের থেকে আলাদা করা যায়।
সভ্যতার অর্জন ও অবদান
‘ইয়াং’ এবং ‘ইন’ নামের দুটো শক্তিকে বৃত্তাকারে ঘিরে থাকা এক বৃত্তের মাধ্যমে সৃষ্টিকুলের পরিচয় হিসেবে দেখে চীনা দর্শন। বৃত্তের এক অংশ ছিল সাদা আর অন্যটি কালো। ঔজ্জ্বল্য, উষ্ণতা, কর্মক্ষমতাকে চীনারা ‘ইয়াং’ শীর্ষক পুরুষসত্তা আর ঠিক তার বিপরীতে অন্ধকার, নীরবতা, শীতলতা ও কোমলতার প্রতীক হিসেবে ‘ইন’ নামের নারীসত্তাকে কল্পনায় ঠাঁই দিয়েছিল। ওদিকে তাদের হিসেবে এই ‘ইয়াং’ এবং ‘ইন’ এর মিলনে জন্ম নিয়েছিল ‘পানকু’ নামের পৌরাণিক মানব। তাদের হিসেবে এই পানকুই রূপ নিয়েছিল প্রাচীন পৃথিবীতে।
চীনা বিশ্বাসে পানকুর তিনজন সহকারী ছিল টার্টল তথা কাছিম, কুইলিন, ‘ড্রাগন’ ও ‘ফিনিক্স’। পৌরাণিক যুগের শাসক হিসেবে চার হাজার বছর পূর্বে চীনের বিভিন্ন জাতি মিলে নির্বাচিত হুয়াং তি (Huang Ti/ Huangdi) এর নাম বলা যায়। তিনি হোয়াংহো নদীর উপত্যকায় রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। ওদিকে হলদে সম্রাট (The Yellow Emperor/Yellow Thearch) নামে পরিচিত হুয়াং তির সময় চীনের লোকেরা গুটিপোকার চাষ, নৌকা ও মালটানা গাড়ি তৈরির পদ্ধতি আয়ত্ত করেছিল। তাদের লিখনপদ্ধতির সূচনাও হয়েছিল তখন। ‘ইয়াও’, ‘সুন’, এবং ‘উ’ এরপর তাদের রাজা হয়েছিলেন।
চীনের রাজারা হোয়াংহো নদীর ভয়াবহ প্লাবনের সময় বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় উদ্ভাবন করেছিলেন। এমনকি তারা, লিখনপদ্ধতি, মাছ ধরা, সংগীত, চিত্রকলা, পশুপালন এবং রেশম চাষ সম্পর্কে ধারণা প্রদান করেন। ওদিকে কৃষি, বাণিজ্য ও চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কেও তাদের উপযুক্ত ধারণা ছিল দীর্ঘদিন। এছাড়া চৈনিক ইতিহাসের সূত্র হিসেবে হাড়ের উপর লিখিত লিপি পাওয়া যায়।
চীনের হোয়াংহো নদীতে প্রচুর বন্যা হতো। এই বন্যা চীনাদের পাঁচবার রাজধানী স্থানান্তরে বাধ্য করেছিল। অনেকটা আদিম ধরনের কৃষিপদ্ধতি ও উপকরণ ব্যবহার করলেও চৈনিক অর্থনীতির মূলভিত্তিই ছিল কৃষি। গম ও যব প্রধান উৎপাদিত শস্য হলেও কিছু পরিমাণ ধান তারা চাষ করতো। তারা শিকার ও পশুপালনের মাধ্যমে মাংস চাহিদা পূরণ করত। তখনকার সাধারণ মানুষ পশু হিসেবে কুকুর, শূকর, ছাগল, ভেড়া, ষাঁড়, ঘোড়া, হাঁস মুরগি, মহিষ, বানর এবং হাতিও পালন করত। শূকরের মাংসের মতো তাদের খাদ্য-তালিকায় কুকুরের মাংসও বেশ জনপ্রিয় ছিল। কৃষি ও পশুপালনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় শাং জনগোষ্ঠী যাযাবর ছিল না। তারা মাটির ঘর কিংবা গর্তে বাস করত।
যতটুকু জানা গিয়েছে চৈনিক রাজা একাধারে সৈন্যবাহিনী নিয়ন্ত্রণ, বেসামরিক কার্যাবলির তত্ত্বাবধান এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিত। পুরোহিতরা তখন ধর্মীয় দায়িত্ব ছাড়াও জ্যোতিষ শাস্ত্রের চর্চা করত। তারা ক্যালেন্ডার তৈরিতেও ভূমিকা রাখত। পুরোহিতরা অঙ্ক ও গণিতশাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। চৌদ্দ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের শুরুতে চীনারা সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের সময় নির্ধারণ করতে পেরেছিল যা ছিল যুগান্তকারী।
গ্রিকসভ্যতা
পটভূমি: ইজিয়ান সাগরের দ্বীপপুঞ্জে এবং এশিয়া মাইনরের পশ্চিম উপকূলে আবিষ্কৃত হয় উন্নত এক প্রাচীন নগর সভ্যতা। সন্ধান মেলে মহাকাব্যের ট্রয় নগরীসহ একশ নগরীর ধ্বংসস্তূপের। যাকে বলা হয় ইজিয়ান সভ্যতা বা প্রাক-ক্লাসিক্যাল গ্রিকসভ্যতা।
ক্রিট দ্বীপ, গ্রিস উপদ্বীপের মূল ভূখণ্ড, এশিয়া মাইনরের পশ্চিম উপকূলে এবং ইজিয়ান সাগরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠে এই সভ্যতা। এই সভ্যতার অধিবাসীরা ছিল সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের অধিকারী। এই সভ্যতাকে দুইটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
১. মিনিয়ন সভ্যতা: ক্রিট দ্বীপে যে সভ্যতার উদ্ভব এর স্থায়িত্ব ধরা হয়েছে ৩০০০ থেকে ১৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত।
২. দ্বিতীয়টি হচ্ছে মাইসিনীয় বা ইজিয়ান সভ্যতা: গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে দক্ষিণ অঞ্চলে অবস্থিত মাইসিনি নগরের নাম অনুসারে এর নামকরণ হয়। এই সভ্যতার স্থায়িত্ব ছিল ১৬০০ থেকে ১১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। ধারণা করা হয় বন্যা অথবা বিদেশি আক্রমণের ফলে এই সভ্যতার অবসান ঘটে।
ভৌগোলিক অবস্থান ও সময়কাল: গ্রিস দেশটি আড্রিয়াটিক সাগর, ভূমধ্যসাগর ও ইজিয়ান সাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। গ্রিকসভ্যতার সঙ্গে দুইটি সংস্কৃতির নাম জড়িত। একটি ‘হেলেনিক’ অপরটি ‘হেলেনিস্টিক’। গ্রিক উপদ্বীপের প্রধান শহর এথেন্সকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ‘হেলেনিক সংস্কৃতি’। অপরদিকে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াকে কেন্দ্র করে গ্রিক ও অ-গ্রিক সংস্কৃতির মিশ্রণে জন্ম হয় নতুন এক সংস্কৃতির। ইতিহাসে এ সংস্কৃতি ‘হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি’ নামে পরিচিত।
সামরিক নগররাষ্ট্র স্পার্টা: প্রাচীন গ্রিসে যে অসংখ্য নগররাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল তার একটি ছিল স্পার্টা। এ নগররাষ্ট্রের অবস্থান ছিল দক্ষিণ গ্রিসের পেলোপনেসাস নামক অঞ্চলে। অন্যান্য নগররাষ্ট্র থেকে স্পার্টা ছিল আলাদা। স্পার্টানদের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সমরতন্ত্র দ্বারা তারা প্রভাবিত ছিল। মানুষের মানবিক উন্নতির দিকে নজর না দিয়ে সামরিক শক্তি সঞ্চয়ের দিকে তাদের দৃষ্টি ছিল বেশি। ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দীর্ঘ যুদ্ধের পর ডোরিয় যোদ্ধারা স্পার্টা দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। এই পরাজিত স্থানীয় অধিবাসীদের ভূমিদাস বা হেলট বলা হতো। এরা সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করত।
পরাজিত অধিবাসী যারা ভূমিদাস হতে বাধ্য হয়েছিল তাদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। ফলে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা আর বিদ্রোহ দমন ছাড়া স্পার্টার রাজাদের মাথায় আর কোনো চিন্তা ছিল না। স্পার্টানদের জীবন স্পার্টা রক্ষার জন্যই নিয়োজিত ছিল। স্পার্টার সমাজ তৈরি হয়েছিল যুদ্ধের প্রয়োজনকে ঘিরে। সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের জন্য নাগরিকদের প্রস্তুত করা ও যুদ্ধ পরিচালনা করা। সামরিক দিকে অত্যধিক মনোযোগ দেওয়ার কারণে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তারা ছিল অনগ্রসর।
গণতান্ত্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্স: প্রাচীন গ্রিসে প্রথম গণতন্ত্রের সূচনা হয় এথেন্সে। তবে প্রথম দিকে এথেন্সে ছিল রাজতন্ত্র। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে রাজতন্ত্রের পরিবর্তে এক ধরনের অভিজাততন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতা চলে আসে অভিজাতদের হাতে। দেশ শাসনের নামে তারা শুধু নিজের স্বার্থই দেখত। ফলে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। যদিও তাদের পক্ষে ক্ষমতা দখল করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাদের নামে কিছু লোক ক্ষমতা হাতে নিয়ে নেয়। তাদের বলা হতো ‘টাইরান্ট’। জনগণের মধ্যে অসন্তোষ এবং বঞ্চিত কৃষকদের মধ্যে বিদ্রোহের আশঙ্কা দেখা দেয়। ফলে সপ্তম খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মাঝামাঝি সময়ে রাষ্ট্রব্যবস্থায় এক পরিবর্তন আসে। আগে অভিজাত পরিবারের সন্তান অভিজাত বলে গণ্য হতো। এখন অর্থের মানদণ্ডে অভিজাত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো।
দেশে মারাত্মক সংকটের সময়ে সব শ্রেণি সর্বসম্মতভাবে কয়েকজনকে সংস্কারের জন্য আহ্বান জানায়। তার মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন অভিজাত বংশে জন্ম নেওয়া ‘সোলন’। তিনি কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করেন এবং গ্রিক আইনের কঠোরতা হ্রাস করেন। তিনি ঋণ থেকে কৃষকদের মুক্ত করার জন্য আইন পাস করেন। তাঁর সময় অনেক অর্থনৈতিক সংস্কারও করা হয়।
সোলনের পর জনগণের কল্যাণে তাদের অধিকার দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন পিসিসট্রেটাস এবং ক্লিসথেনিস। তারা জনগণের কল্যাণের জন্য অনেক আইন পাস করেন। তবে চূড়ান্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় পেরিক্লিসের সময়। তার সময়কে গ্রিকসভ্যতার ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়ে থাকে। ৪৬০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ক্ষমতায় এসে তিনি ৩০ বছর রাজত্ব করেন। তিনি নাগরিকদের সব রাজনৈতিক অধিকারের দাবি মেনে নেন।
তিনি এ সময় প্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগে নাগরিকদের অবাধ অংশগ্রহণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। নাগরিকদের মধ্য থেকে নিযুক্ত জুরি বিচারের দায়িত্ব পালন করত।
পেরিক্লিসের যুগে এথেন্স সর্বক্ষেত্রে উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। ৪৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এথেন্সের ভয়াবহ মহামারিতে এক-চতুর্থাংশ লোক মৃত্যুবরণ করে। এই মহামারিতে পেরিক্লিসেরও মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যুর পর পরই এথেন্সের দুর্ভোগ শুরু হয়।
জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য ও রাজনীতি সর্বক্ষেত্রে বিশ্বসভ্যতায় অবিস্মরণীয় অবদান রাখা নগররাষ্ট্র এথেন্সের পতন হয় সামরিক নগররাষ্ট্র স্পার্টার কাছে। উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তা ইতিহাসে পেলোপনেসিয়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত। ৪৬০ থেকে ৪০৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মোট তিনবার এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে দুই রাষ্ট্র পরস্পরের মিত্রদের নিয়ে জোট গঠন করে। এথেন্সের মিত্র রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত জোটের নাম ছিল ‘ডেলিয়ান লীগ’। অপরদিকে স্পার্টা তার মিত্রদের নিয়ে যে জোট গঠন করে, তার নাম ছিল ‘পেলোপনেসীয় লীগ’। এই মরণপণ যুদ্ধে এথেন্সের মান-মর্যাদা ও স্বাধীনতা বিলীন হয়ে যায়। ৩৬৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এথেন্স চলে যায় স্পার্টার অধীনে। এরপর নগররাষ্ট্র থিবস্ অধিকার করে নেয় এথেন্স। ৩৩৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মেসিডোনের (গ্রিস) রাজা ফিলিপ থিরাস দখল করে নিলে এথেন্স মেসিডোনের অধীনে চলে যায়।
সভ্যতায় গ্রিসের অবদান : ভৌগোলিক কারণে গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলো একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলেও তাদের সংস্কৃতি ছিল অভিন্ন। রাজনৈতিক অনৈক্য থাকা সত্ত্বেও তারা একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী বলে মনে করত। তাদের ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য, খেলাধুলা- সবকিছু এক সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছিল। এই সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল অবদান ছিল এথেন্সের। আর এই সংস্কৃতির নাম হচ্ছে হেলেনীয় সংস্কৃতি।
শিক্ষা: শিক্ষা সম্পর্কে গ্রিক জ্ঞানী-গুণীরা বিভিন্ন ধারণা পোষণ করতেন। তারা নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ মনে করতেন সুশিক্ষিত নাগরিকের হাতেই শাসনভার দেওয়া উচিত। সরকারের চাহিদা ও লক্ষ্য অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থা থাকা উচিত। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল আনুগত্য ও শৃঙ্খলা শিক্ষা দেওয়া। স্বাধীন গ্রিসবাসীর ছেলেরা সাত বছর বয়স থেকে পাঠশালায় যাওয়া-আসা করত। ধনী ব্যক্তিদের ছেলেদের ১৮ বছর পর্যন্ত লেখাপড়া করতে হতো। কারিগর আর কৃষকের ছেলেরা প্রাথমিক শিক্ষা পেত। দাসদের সন্তানের জন্য বিদ্যালয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। মেয়েরাও কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া করতে পারত না।
সাহিত্য: সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রাচীন গ্রিসের সৃষ্টি আজও মানবসমাজে মূল্যবান সম্পদ। হোমারের ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ মহাকাব্য তার অপূর্ব নিদর্শন। সাহিত্য ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিল নাটক রচনায়। বিয়োগান্ত নাটক রচনায় গ্রিকরা বিশেষ পারদর্শী ছিল। এসকাইলাসকে এই ধরনের নাটকের জনক বলা হয়। তাঁর রচিত নাটকের নাম ‘প্রমিথিউস বাউন্ড’। গ্রিসের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ছিলেন সোফোক্লিস। তিনি একশটিরও বেশি নাটক রচনা করেন।
ইতিহাস রচনায়ও গ্রিকরা কৃতিত্ব দেখিয়েছিল। হেরোডটাস ইতিহাসের জনক নামে পরিচিত ছিলেন। হেরোডটাস রচিত ইতিহাস-সংক্রান্ত প্রথম বইটি ছিল গ্রিস ও পারস্যের মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে। থুকিডাইডেস ছিলেন বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসের জনক। তাঁর বইটির শিরোনাম ছিল ‘দ্য পেলোপনেসিয়ান ওয়র’।
ধর্ম: গ্রিকদের বারোটি দেব-দেবী ছিল। বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির পূজা ছাড়াও তারা বীরযোদ্ধাদের পূজা করত। জিউস ছিল দেবতাদের রাজা। অ্যাপোলো ছিলেন সূর্য দেবতা, পোসিডন ছিলেন সাগরের দেবতা। এথেনা ছিলেন জ্ঞানের দেবী। বারোজনের মধ্যে এই চারজন ছিলেন শ্রেষ্ঠ। রাষ্ট্রের নির্দেশে পুরোহিতরা ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতেন। ডেলোস দ্বীপে অবস্থিত ডেলফির মন্দিরে বিভিন্ন নগররাষ্ট্রের মানুষ সমবেত হয়ে এক সঙ্গে অ্যাপোলো দেবতার পূজা করত।
দর্শন: দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে গ্রিসে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিল। পৃথিবী কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে, প্রতিদিন কীভাবে এর পরিবর্তন ঘটছে-এসব ভাবতে গিয়ে গ্রিসে দর্শনচর্চার সূত্রপাত। থালেস ছিলেন প্রথম দিককার দার্শনিক। তিনিই প্রথম সূর্যগ্রহণের প্রাকৃতিক কারণ ব্যাখ্যা করেন। এরপর গ্রিসে যুক্তিবাদী দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের বলা হতো সফিস্ট। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, চূড়ান্ত সত্য বলে কিছু নেই। পেরিক্লিস তাঁদের অনুসারী ছিলেন। সক্রেটিস ছিলেন এ দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান। তার শিক্ষার মূল দিক ছিল আদর্শ রাষ্ট্র ও সৎ নাগরিক গড়ে তোলা। অন্যায় শাসনের প্রতিবাদ করার শিক্ষাও তিনি দেন। সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো গ্রিক দর্শনকে চরম উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটলও একজন বড় দার্শনিক ছিলেন।
বিজ্ঞান: গ্রিকরা প্রথম বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত করে ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। পৃথিবীর মানচিত্র প্রথম অঙ্কন করেন গ্রিক বিজ্ঞানীরা। তারাই প্রথম প্রমাণ করেন যে, পৃথিবী একটি গ্রহ এবং তা নিজ কক্ষপথে আবর্তিত হয়। গ্রিক জ্যোতির্বিদরা সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের কারণ নির্ণয় করতে সক্ষম হন। চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। বজ্র ও বিদ্যুৎ জিউসের ক্রোধের কারণে নয়, প্রাকৃতিক কারণে ঘটে- এই সত্য তারাই প্রথম আবিষ্কার করেন। জ্যামিতির পণ্ডিত ইউক্লিড পদার্থবিদ্যায়ও পারদর্শী ছিলেন। বিখ্যাত গণিতবিদ পিথাগোরাস ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিপোক্রেটসের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল।
স্থাপত্য ও ভাস্কর্য: গ্রিক শিল্পের বিশেষ করে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে বিশেষ উন্নতি হয়েছিল। গ্রিক চিত্রশিল্পের নিদর্শন মৃৎপাত্রে আঁকা চিত্রের মধ্যে দেখা যায়। স্থাপত্যের সুন্দর সুন্দর নিদর্শন গ্রিসের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে। বড় বড় স্তম্ভের উপর তারা প্রাসাদ তৈরি করত। আর প্রাসাদের স্তম্ভগুলো থাকত অপূর্ব কারুকার্যখচিত। পার্থেনন মন্দির বা দেবী এথেনার মন্দির স্থাপত্য কীর্তির অন্যতম নিদর্শন। এথেন্সের অ্যাক্রোপলিসে স্থাপত্যের সুন্দর নিদর্শনের ভগ্নাবশেষ এখনও চোখে পড়ে।
গ্রিক ভাস্কর্য পৃথিবীর শিল্পকলার ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগের জন্ম দিয়েছিল। সে যুগের প্রখ্যাত ভাস্কর্য শিল্পী ছিলেন মাইরন, ফিদিয়াস ও প্রাকসিটেলেস।
খেলাধুলা: শিশুদের খেলাধুলার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হতো। বিদ্যালয়ে তাদের খেলাধুলার হাতেখড়ি হতো। শরীরচর্চা খেলাধুলার প্রতি গ্রিকদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। উৎসবের দিনে গ্রিসে নানা ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল দেবতা জিউসের সম্মানে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতা।
অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় গ্রিসের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদরা অংশ নিত। এতে দৌড়ঝাঁপ, মল্লযুদ্ধ, চাকা নিক্ষেপ, বর্শা ছোড়া, মুষ্টিযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা থাকত। বিজয়ীদের জলপাই গাছের ডাল-পাতায় তৈরি মালা দিয়ে পুরস্কৃত করা হতো। প্রতি চার বছর পরপর এই খেলা অনুষ্ঠিত হতো। এ খেলায় বিভিন্ন নগররাষ্ট্রের খেলোয়াড়রা অংশ নিত। এই খেলাকে ঘিরে গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শত্রুতার বদলে সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব গড়ে ওঠে।
রোমান সভ্যতা
পটভূমি: গ্রিক সভ্যতার অবসানের আগেই ইতালিতে টাইবার নদীর তীরে একটি বিশাল সাম্রাজ্য ও সভ্যতা গড়ে ওঠে। রোমকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা রোমান সভ্যতা নামে পরিচিত। প্রথম দিকে রোম একজন রাজার শাসনাধীন ছিল। এ সময় একটি সভা ও সিনেট ছিল। রাজা স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ৫১০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমে একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রোমান সভ্যতা প্রায় ছর’শ বছর স্থায়ী হয়েছিল।
ভৌগোলিক অবস্থান ও সময়কাল: ইতালির মাঝামাঝি পশ্চিমাংশে রোম নগর অবস্থিত। ইতালির দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর থেকে উত্তর দিকে আল্পস্ পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত। ইতালি ও এককালের যুগোস্লাভিয়ার মাঝখানে আড্রিয়াটিক সাগর। আড্রিয়াটিক সাগর তীরে ইতালির উত্তর-পূর্ব অংশে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন সমুদ্রবন্দর এড্রিয়া। ইতালির পশ্চিমাংশেও ভূমধ্যসাগর অবস্থিত। সাগরের এ অংশকে প্রাচীনকালে বলা হতো এটুস্কান সাগর। কৃষি বিকাশের সুযোগ ছিল বলে প্রাচীন রোম ছিল কৃষিনির্ভর দেশ। ফলে রোমের আদি অধিবাসীদের সঙ্গে অনুপ্রবেশকারীদের সংঘর্ষ সাধারণ বিষয় ছিল। যে কারণে এসব সংঘাত-সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে রোমানরা যোদ্ধা জাতিতে পরিণত হতে থাকে। রোমান ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নানা উত্থান-পতন, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ৭৫৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোম নগরী প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে জার্মান যোদ্ধা জাতিগুলোর হাতে রোমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।
রোম নগরী ও রোমান শাসনের পরিচয়: গুরুত্বপূর্ণ টাইবার নদীর উৎসমুখ থেকে প্রায় বারো-তেরো মাইল দূরে সাতটি পর্বতশ্রেণির ওপর রোম অবস্থিত। এজন্য একে সাতটি পর্বতের নগরীও বলা হয়। ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর একদল মানুষ ইতালিতে বসবাস শুরু করে। তাদেরকেই লাতিন বলা হতো। তাঁদের নাম অনুসারে ভাষার নামও হয় লাতিন ভাষা। লাতিন রাজা রোমিউলাস রোম নগরীর প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নাম অনুযায়ী নগরের নাম হয় রোম।
রোমের গণতন্ত্র একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ধাপে ধাপে নানা সংস্কার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রোমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিকরা রোমান ইতিহাসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা: ৭৫৩-৫১০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ছিল রাজতন্ত্রের যুগ। এ যুগে সাতজন সম্রাট দেশ শাসন করেন। এ যুগের সর্বশেষ সম্রাট টারকিউনিয়াস সুপারকাসকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর রোমে প্রজাতন্ত্রের সূত্রপাত হয়। এই প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চলে ৫০০ থেকে ৬০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। রোমে প্রজাতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে জনগণ বিদ্রোহী নেতা ব্রুটাস এবং অপর এক ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে শাসনের সুযোগ প্রদান করে। রাজতন্ত্রের পতনের পর রোমের জনগণ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, প্যাট্রিসিয়ান অর্থাৎ অভিজাত শ্রেণি, আর প্লিবিয়ান বারা সাধারণ নাগরিক। ক্ষুদ্র কৃষক, কারিগর, বণিকরা প্লিবিয়ান শ্রেণিভুক্ত।
প্রজাতন্ত্রের প্রথম ২০০ বছর ছিল প্যাট্রিসিয়ান ও প্লিবিয়ানদের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাস। সমাজে প্লিবিয়ানরা বঞ্চিত শ্রেণি ছিল। অধিকারবঞ্চিত প্লিবিয়ানরা ক্রমাগত সংগ্রাম করতে থাকে। প্লিবিয়ানদের দাবির মুখে রোমান আইন সংকলিত হতে থাকে। ৪৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্লিবিয়ানরা ব্রোঞ্জপাতে ১২টি আইন লিখিতভাবে প্রণয়ন করে। আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় হিসেবে দুজন কনসালের মধ্যে একজন প্লিবিয়ানদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এভাবে রোমান প্রজাতন্ত্র গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হয়।
রোমে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও ক্রমে দেশটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। স্বল্প সময়ের মধ্যে রোম সমগ্র ইতালির ওপর প্রভাব বিস্তারে তৎপর হয়। ১৪৬ থেকে ৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রোমান সভ্যতার অন্ধকার যুগ। ধনী-দরিদ্র সংঘাত, দাস বিদ্রোহ, ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে চরম বিশৃঙ্খলা, হানাহানি ও সহিংসতায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে রোম।
রোমের অর্থনীতি ছিল দাসদের ওপর নির্ভরশীল। শাসকদের অমানুষিক নির্বাতনে দাসরা স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। দুই বছরব্যাপী তারা তাদের বিদ্রোহ টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। ৭১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে স্পার্টাকাস নিহত হলে বিদ্রোহের অবসান হয়। চরম নির্যাতন নেমে আসে দাসদের ওপর।
অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ছাড়াও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়ে রোম। ফলে উচ্চাকাঙ্ক্ষী সামরিক নেতারা ক্ষমতায় আসতে থাকেন এবং রোমে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বের একপর্যায়ে সমঝোতার ভিত্তিতে তিনজন নেতা একযোগে ক্ষমতায় আসেন, যা ইতিহাসে ত্রয়ী শাসন নামে পরিচিত। বিশাল রোম সাম্রাজ্যকে তিন ভাগ করে শাসনের দায়িত্ব নেন অক্টোভিয়াস সিজার, মার্ক এন্টনি ও লেপিডাস। লেপিডাসের দায়িত্বে ছিল আফ্রিকার প্রদেশসমূহ, অক্টোভিয়াস সিজারের দায়িত্বে ছিল ইতালিসহ সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশ, এন্টনির দায়িত্বে ছিল পূর্বাঞ্চল। তবে তিনজনের শাসন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কারণ প্রত্যেকেরই আকাঙ্ক্ষা ছিল রোমের একচ্ছত্র অধিপতি বা সম্রাট হওয়ার। ফলে খুব শীঘ্রই আবার ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়ে যায়। অক্টোভিয়াস সিজার পরাজিত করে লেপিডাসকে, এদিকে মার্ক এন্টনি মিশরের রাজকন্যা ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করে তাঁর শক্তি বৃদ্ধি করেন। কিন্তু অক্টোভিয়াস সিজারের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরাজিত হন। ক্ষমতা দখল করে অক্টোভিয়াস সিজার অগাস্টাস সিজার নাম ধারণ করে সিংহাসন আরোহণ করেন। ইতিহাসে তিনি এই নামেই বেশি পরিচিত। ১৪ খ্রিষ্টাব্দে অগাস্টাস সিজারের মৃত্যু হয়। তাঁর সময়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা যিশুখ্রিষ্টের জন্ম। অগাস্টাস সিজারের মৃত্যুর পর রোমে আবার বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বিদেশি আক্রমণ, বিশেষ করে জার্মান বর্বর গোত্রগুলোর আক্রমণ তীব্র হতে থাকে। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার কোন্দলের কারণে রোমানদের শক্তি ক্ষয় হয়ে যেতে থাকে। রোমের শেষ সম্রাট রোমিউলাস অগাস্টুলাস জার্মান বর্বর গোত্রের তীব্র আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হলে ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। ইতোমধ্যে খ্রিষ্টধর্মের অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং জার্মানদের উত্থান ঘটে।
সভ্যতায় রোমের অবদান : রোম শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, স্থাপত্য সর্বক্ষেত্রে গ্রিকদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তারা এসব বিষয়ে গ্রিকদের অনুসরণ ও অনুকরণ করেছে। তবে সামরিক সংগঠন, শাসন পরিচালনা, আইন ও প্রকৌশল বিদ্যায় তারা গ্রিক ও অন্যান্য জাতির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। এক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্ব রোমানদের কাছে ব্যাপক ঋণী।
শিক্ষা, সাহিত্য ও লিখন পদ্ধতি: এ সময়ে শিক্ষা বলতে বোঝাতো খেলাধুলা ও বীরদের স্মৃতিকথা বর্ণনা করা। যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে রোমের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সুতরাং তাদের সবকিছুই ছিল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। তারপরও উচ্চ শ্রেণিভুক্ত রোমানদের গ্রিক ভাষা শিক্ষা ছিল একটি ফ্যাশন। ফলে এদের অনেকেই গ্রিক সাহিত্যকে লাতিন ভাষায় অনুবাদ করার দক্ষতা অর্জন করে। রোমের অভিজাত যুবকরা গ্রিসের বিভিন্ন বিখ্যাত বিদ্যাপীঠে শিক্ষালাভ করতে যেত।
সে যুগে সাহিত্যে অবদানের জন্য প্লুটাস ও টেরেন্সর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা দুজন মিলনাত্মক নাটক রচনার ক্ষেত্রে কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। সাহিত্য ক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নতি দেখা যায় অগাস্টাস সিজারের সময়। এ যুগের কবি হোরাস ও ভার্জিল যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ভার্জিলের মহাকাব্য ‘ইনিড’ বহু ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। ওভিদ ও লিভি এ যুগের খ্যাতনামা কবি। লিভি ইতিহাসবিদ হিসেবেও বিখ্যাত ছিলেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ট্যাসিটাসও এ যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও বিজ্ঞান: রোমান স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এর বিশালতা। সম্রাট হার্ডিয়ানের তৈরি ধর্মমন্দির প্যানথিয়ন রোমানদের স্থাপত্যের এক অসাধারণ নিদর্শন। ৮০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট টিটাস কর্তৃক নির্মিত কলোসিয়াম নাট্যশালা নির্মিত হয়, যেখানে একসঙ্গে ৫৬০০ দর্শক বসতে পারত। স্থাপত্যকলার পাশাপাশি রোমান ভাস্কর্যেরও উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। রোমান ভাস্করগণ দেব-দেবী, সম্রাট, দৈত্য, পুরাণের বিভিন্ন চরিত্রের মূর্তি তৈরি করতেন মার্বেল পাথরের।
বিজ্ঞানীদের মধ্যে কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হন। তাদের মধ্যে প্লিনি বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশ্বকোষ প্রণয়ন করেন। এতে প্রায় পাঁচ’শ বিজ্ঞানীর গবেষণাকর্ম স্থান পেয়েছে। তাছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোমানদের অবদান ছিল। বিজ্ঞানী সেলসাস চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর বই লেখেন। এছাড়া চিকিৎসাশাস্ত্রে গ্যালেন রুফাসে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
ধর্ম, দর্শন ও আইন: রোমানরা ধর্মীয় ক্ষেত্রেও গ্রিকদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। অনেক গ্রিক দেব-দেবীর নাম পরিবর্তন হয়ে রোমানদের দেব-দেবী হয়েছে। রোমানদের অন্যতম প্রধান দেবতার নাম ছিল জুপিটার। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেব-দেবী হচ্ছে জুনো, নেপচুন, মার্ক্স, ভলকান, ভেনাস, মিনার্ভা, ব্যাকাস ইত্যাদি। রোমান দেবমন্দিরে প্রধান পুরোহিত ছিলেন যাঁরা, তাঁরা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। তবে রোমানদের পরকালের প্রতি বিশ্বাস ছিল না। অগাস্টাস সিজারের সময় থেকে ঈশ্বর হিসেবে সম্রাটকে পূজা করার রীতি চালু হয়। উল্লেখ্য, এ সময় খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিষ্টের জন্ম হয়। পরবর্তীকালে রোমান ধর্মের পাশাপাশি খ্রিষ্টধর্ম বিস্তার লাভ করতে থাকে। অনেক রোমান এই ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে। এতে সম্রাট ক্ষুব্ধ হন। কারণ খ্রিষ্টধর্মের অনুশাসন মেনে চলতে গেলে সম্রাটকে আর ঈশ্বরের মতো পূজা করা যায় না। ফলে রোমান সম্রাটরা এই ধর্ম প্রচার বন্ধ করে দেন এবং খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণকারী রোমানদের ওপর নির্যাতন শুরু করেন। কিন্তু সম্রাট কন্সটানটাইন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং এই ধর্মকে রোমান সরকারি ধর্মে পরিণত করেন।
অনেকে মনে করেন যে, রোমীয় দর্শন গ্রিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তবুও রোমান দর্শনে সিসেরো, লুক্রেটিয়াস (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৯৮-৫৫) তাঁদের সুচিন্তিত দার্শনিক মতবাদ দ্বারা অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। রোমে স্টোইকবাদী দর্শন যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। ১৪০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ রোডস দ্বীপের প্যানেটিয়াস এই মতবাদ রোমে প্রথম প্রচার করেন।
বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে রোমানদের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে আইন প্রণয়ন। খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রোমানরা ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইনগুলো সুষ্ঠুভাবে একসঙ্গে সাজাতে সক্ষম হন। ৫৪০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ১২টি ব্রোঞ্জ পাতে সর্বপ্রথম আইনগুলো খোদাই করে লিখিত হয় এবং জনগণকে দেখাবার জন্য প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়। রোমান আইনের দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান। রোমান আইনকে তিনটি শাখায় ভাগ করা হয়েছে। যেমন-
১. বেসামরিক আইন: এই আইন পালন করা রোমান নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। এই আইন লিখিত অলিখিত দুই রকম ছিল।
২. জনগণের আইন এ আইন সকল নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য ছিল। তাছাড়া ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষার বিষয়টি এই আইনে ছিল। তবে এর মাধ্যমে দাসপ্রথাও স্বীকৃতি লাভ করে। সিসেরো এ আইনের প্রণেতা।
৩. প্রাকৃতিক আইন: এ আইনে মূলত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে।
আধুনিক বিশ্ব সম্পূর্ণভাবে রোমান আইনের ওপর নির্ভরশীল। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে সম্রাট জাস্টিনিয়ান প্রথম সমস্ত রোমান আইনের সংগ্রহ ও সংকলন প্রকাশ করেন।
মায়া সভ্যতা
আমেরিকার তিনটি সভ্যতা হচ্ছে যথাক্রমে মায়া, আজটেক ও ইনকা। গুয়েতেমালা ও মেক্সিকোর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সমৃদ্ধ জনপদ ছিল মায়া সভ্যতা। প্রাচীনলিপি থেকে জানা গিয়েছে, মায়া অঞ্চলের লোকেরা ভাবের আদান-প্রদান করার জন্যে একটি ভাষার ব্যবহার করত। তাদের এই ভাষার লিখিত রূপটি ছবি বা চিহ্ন ব্যবহার করায় অনেকটা হায়ারোগ্লিফিক ধাঁচের ছিল। প্রায় ৮০০টির বেশি ছবি ব্যবহার করে তারা এই লিপির প্রচলন ঘটিয়েছিল। মায়ানদের এই লেখা থেকে তাদের সভ্যতা সম্পর্কে জানা যায়। তারা গাছের বাকল দিয়ে তৈরি করা কাগজ থেকে বানাতো কোডেক্স নামের বই।
অর্জন
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে মায়া অঞ্চলের মানুষ কৃষিকাজ, মাটির পাত্র নির্মাণ প্রভৃতি আয়ত্ত করার মধ্য দিয়ে নব্য প্রস্তর সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়। তারপর সংস্কৃতির ধারাবাহিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে তারা সভ্যতায় পদার্পণ করেছিল। মায়া সভ্যতার ইতিহাসকে দুটো অংশে বিভক্ত করা হয়েছে- ক. প্রথম শুর (৩১৭-৯৮৭ খ্রি.) খ. শেষ স্তর (৯৮৭-১৬৯৭ খ্রি.)।
বেলিজের কিউল্লোতে সম্প্রতি মায়া সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। সেখানকার নমুনার রেডিও কার্বন পরীক্ষা করে কালমিতিক সময় পাওয়া গিয়েছে। সেই সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ২৬০০ বছর আগের। তখনই তারা বিস্ময়কর স্থাপত্য কাঠামো নির্মাণ করেছিল। পাশাপাশি মায়া সভ্যতায় ছিল গুরুত্বপূর্ণ বর্ষপঞ্জিকা।
কৃষি
ধারণা করা হয় প্রায় ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মায়া অঞ্চলের মানুষ চাষাবাদ করা শুরু করেছিল। প্রথম দিকে তাদের কৃষিনির্ভর গ্রামে সংস্কৃতির উৎপত্তি ঘটেছিল। আনুমানিক ১৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রথম মায়া জনবসতি প্রতিষ্ঠা পায় প্রশান্ত মহাসাগর তীরবর্তী সোকোনুস্কো অঞ্চলে। তারা মৃৎপাত্র তৈরি, কৃষিকাজ ও পোড়ানো কাদামাটির মূর্তি বানানোর মতো দক্ষতা অর্জন করেছিল।
অনেক গবেষক ধারণা করেছেন বর্তমান গুয়াতেমালার অন্তর্গত পিতেন অঞ্চলের নিম্নভূমিতে ৩১৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মায়া সভ্যতার প্রথম সূত্রপাত ঘটেছিল। গভীর বনভূমি পরিষ্কার করে স্থানীয়রা বসতি স্থাপন করেছিল। তারা কঠোর পরিশ্রম করে জমিকে কৃষিযোগ্য করে তুলেছিল। ফলাফল হিসেবে মায়া অঞ্চলের কৃষকরা শিম, ভুট্টা, টমাটো, লাউ, মিষ্টি আলু, কাসাভা প্রভৃতির চাষ করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছে। তারপর টিকল, কোপান, পালে প্রভৃতি শহরকে কেন্দ্র করে রহস্যময় মায়া সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল। তখন গুয়াতেমালাতেই মায়া সভ্যতার কেন্দ্রগুলো অবস্থিত ছিল। অন্যদিকে পালে শহরটির অবস্থান ছিল মেক্সিকো অঞ্চলে।
মায়া সভ্যতার বেশির ভাগ তথ্য লেখা হয়েছিল সোনার পাতে। মূল্যবান ধাতু সোনার পাতে লেখা এই লিপিগুলো ইউরোপীয়রা তাদের আগ্রাসনের সময় লুট করে। তারা পাতগুলো গলিয়ে সোনা ইউরোপে নিয়ে গিয়েছিল। ফলে ঐ সময় মায়াদের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
ইনকা সভ্যতা
লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুর সুউচ্চ সবুজ পাহাড় থেকে নেমে এসেছে উরুবামবা নদী। এই পাহাড়ি এলাকাতেই প্রাচীন ইনকাদের শহর। এখানেই ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৪০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত লাতিন আমেরিকায় ইনকাদের হারানো শহর মাচুপিচু। ১৯১১ সালে মার্কিন ঐতিহাসিক হিরাম বিংহ্যাম এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেন।
তিনি শুরুতে মাচুপিচুকে ভিলকা বাম্বা বলে মনে করেন। তবে অচিরেই বোঝা যায় তার আবিষ্কৃত এলাকা মাচুপিচুই, এটা ভিলকা বাম্বা নয়। কারণ ফ্রান্সিসকো পিজারোর নেতৃত্বাধীন স্প্যানিশ ডাকাতদল লুন্ঠনের পাশাপাশি পুরো ভিলকা বাম্বাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে তারপর প্রতিষ্ঠা করেছিল নতুন শহর লিমা।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উপরে অবস্থিত ইনকা শহর মাচুপিচুর নির্মাণ শেষ হয় ১৪৫০ সালে। ধারণা করা হয় ইনকা সম্রাট পাচাকুটির নির্দেশে হয়েছিল এই নির্মাণ। তবে শত বছর না পেরোতেই পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল শহরটি। কেউ কেউ দাবি করেন- ইউরোপীয়দের আগ্রাসনের সময় মহামারির কবলে পড়েছিল মাচুপিচু। ভয়াবহ মহামারির ফলে বেশির ভাগ মানুষ মারা গেলে পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল ইনকা নগরী মাচুপিচু। অনেক ইতিহাসবিদ দাবি করেছেন মহামারির কবলে পড়ে মাচুপিচু ধ্বংস হয়নি। স্প্যানিশ আগ্রাসনকারীরা সেই ইনকা শহর দখল করতে গিয়ে সেখানকার বেশির ভাগ অধিবাসীকে মেলে ফেলেছিল।
স্প্যানিয়ার্ড দস্যুনেতা ফ্রান্সিসকো পিজারো ১৫৩২ সালে ইনকা সাম্রাজ্য আক্রমণ করে। তখন ইনকা সম্রাট আটাহুয়ালপার রাজধানী ছিল কুজকো শহরে। বর্তমান পেরুতে এর অবস্থান। ইনকারা তাদের সাম্রাজ্য ততদিনে উত্তরে ইকুয়েডর থেকে দক্ষিণে চিলির মধ্যভাগ পর্যন্ত পুরো আন্দিজ পর্বতমালা জুড়ে বিস্তার ঘটাতে পেরেছে।
ইনকাদের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে দেখা যায়- তারা আনুমানিক ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে কুজকো উপত্যকায় বসতি স্থাপন করে। কাপাক প্রথম ইনকা সম্রাট হলেও নবম ইনকা সম্রাট পাচাকুটি ১৪৩৮ সালের দিকে ইনকা সাম্রাজ্যের বিস্তার শুরু করেন। তার সক্ষমতা আর যুদ্ধবাজ নীতি ইনকাদের উত্তর-দক্ষিণে ২,৭০০ মাইল পর্যন্ত বিস্তারের পথ করে দিয়েছিল। উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ইনকা শাসক ছিলেন মানকো কাপাক, মায়তা কাপাক, ইয়াহুয়ার হুয়াকাক, পাচাকুটি ইনকা, টোপা ইনকা এবং হুয়ায়না কাপাক।
মানকো কাপাককে ইনকাদের প্রথম সম্রাট দাবি করা হলেও তাকে নিয়ে ঐতিহাসিকদের সন্দেহ রয়েছে। ধারাবাহিক শাসনের শেষদিকে আতাহুয়ালপার শাসনামলেই স্প্যানিয়ার্ড ডাকাতদল আক্রমণ করেছিল ইনকাদের শহর। তারা লুটপাট ও তছনছ করেছিল ইনকাদের সুসজ্জিত নগর ও সমৃদ্ধ সভ্যতা।
খাদ্য ও কৃষি
তারা গিনিপিগ ও লামার মাংসের পাশাপাশি সামুদ্রিক মাছ ধরতে পারলে সিদ্ধ করে কিংবা পুড়িয়ে খেত। পশ্চিমে প্রশান্ত সাগর আর সেই জগদ্বিখ্যাত টিটিকাকা হ্রদের মাছ ছিল তাদের খুব প্রিয়। পাশাপাশি, ভুট্টা পিষে চিচা নামের তিতকুটে একধরনের পানীয় তৈরি করত ইনকারা।
সিংহভাগ ক্ষেত্রে নিরামিষভোজী হওয়ায় গোল আলু ছিল ইনকাদের প্রধান খাদ্যশস্য। তারা ভুট্টা, নানা ধরনের শিম, মিষ্টি আলু, টমেটো, লাউ, কাঁচা মরিচ ইত্যাদির চাষ করতো। একমাত্র লাউ ছাড়া অন্য সব তরিতরকারি এবং খাদ্যশস্য ইউরোপ, আফ্রিকা বা এশিয়ায় প্রায় অপরিচিত। পাহাড়ীদের প্রধান খাবার ছিল আলু। মাঝারি উচ্চতার ভূমিতে বসবাসকারী মানুষদের প্রধান খাদ্যশস্য ছিল ভুট্টা।
তৎকালীন ইনকা তথা পেরুতে চার প্রজাতির উট জাতীয় প্রাণী ছিল। তাদের নাম যথাক্রমে লামা, আলপাকা, ভিকুনা এবং গুয়ানাকো। প্রথম দুটি প্রাণী আকারে বেশ বড় হলেও ভিকুনা আর গুয়ানোকো ছিল বেশ ছোট, অনেকটা ছাগলের মতো। তবে লামা কিংবা আলপাকাও উটের তুলনায় একেবারে ছোট।
তারা লামাকে গাধার মতো ভারবাহী পশু হিসেবে ব্যবহার করার পাশাপাশি আলপাকাকে পোষ মানাত লোমের জন্য। আলপাকার গাঢ় বাদামি বা কালো রঙের লোম দিয়ে তারা গরম কাপড় তৈরি করত। লামা ও আলপাকার পাশাপাশি কুকুর, গিনিপিগ এবং হাঁস পুষতো তারা।
ইনকারা গিনিপিগের মাংস খেত। পাহাড়ি পথে চলাচলের ক্ষেত্রে পায়ের সুরক্ষায় জুতা ও স্যান্ডেল পরত। ইনকা নারীরা লম্বা একখণ্ড কাপড় দিয়ে তৈরি বিশেষ পোশাক পরতেন। কাপড়টি কাঁধ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পুরো শরীরকে ঢেকে রাখতো।
ধর্ম ও অন্যান্য অর্জন
নারীরা লম্বা চুল রেখে মাথার মাঝখানে সিঁথি করত। পুরুষরা চুল কাটতো সামনের দিকে ছোট করে। তবে পেছনের দিকে বেশ লম্বা ছিল। সব শ্রেণির ইনকা নারী গলায় হার পরার পাশাপাশি শুধু অভিজাত ইনকা পুরুষরা কানে বিশেষ গয়না পরত।
ধারণা করা হয়, ইনকাদের রাজ্যে সব শহরে সূর্যদেবের মন্দির ছিল। মন্দিরের ভেতরে পূজা না হয়ে হতো বাইরের চত্বরে। পুরোহিতরাই মন্দিরে প্রবেশ করে সেখান থেকে পূজার উপকরণ নিয়ে এসে খোলা চত্বরে পূজা অনুষ্ঠান করতো।
ইনকা রাজ্যের সবচেয়ে বড় সূর্যমন্দির ছিল কুজকো শহরে। সব মন্দিরেই অনেকগুলো দালান থাকতো পুরোহিত ও মন্দিরের কর্মচারীদের থাকার জন্য। মন্দির সংলগ্ন আলাদা বাড়িতে সন্ন্যাসিনী বা পবিত্র নারীরা বাস করতেন। সূর্য কুমারী বা মানাকুনা নামের চিরকুমারী সন্ন্যাসিনী এবং নির্বাচিত নারী তথা আকলাকুনারাই এখানে থাকতেন।
আজটেক সভ্যতা
স্প্যানিশ আক্রমণকারীরা ১৫১৯ সালের দিকে মধ্য মেক্সিকোতে আজটেক সভ্যতার এক সমৃদ্ধ নগরের সন্ধান পায়। তারা সমৃদ্ধ এই নগর থেকে বিভিন্ন সম্পদ লুটপাট করে। তাদের আক্রমণের অনেক আগে মেক্সিকো অঞ্চলের জনশ্রুতি ও কিংবদন্তি থেকে আজটেক জাতির নাম শোনা যায়। তারা প্রথম বসতি গড়েছিল আজলটান অঞ্চলে। জায়গাটি ছিল মেক্সিকোর উত্তরে কিংবা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কোথাও। সভ্যতা বিকাশের গোড়ার দিকে আজটেকরা ছিল যাযাবর। তাদের জনসংখ্যা তেমন একটা বেশি ছিল না।
স্প্যানিশ আক্রমণকারীরা ১৫১৯ সালের দিকে মধ্য মেক্সিকোতে আজটেক সভ্যতার এক সমৃদ্ধ নগরের সন্ধান পায়। তারা সমৃদ্ধ এই নগর থেকে বিভিন্ন সম্পদ লুটপাট করে। তাদের আক্রমণের অনেক আগে মেক্সিকো অঞ্চলের জনশ্রুতি ও কিংবদন্তি থেকে আজটেক জাতির নাম শোনা যায়। তারা প্রথম বসতি গড়েছিল আজলটান অঞ্চলে। জায়গাটি ছিল মেক্সিকোর উত্তরে কিংবা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কোথাও। সভ্যতা বিকাশের গোড়ার দিকে আজটেকরা ছিল যাযাবর। তাদের জনসংখ্যা তেমন একটা বেশি ছিল না।
খ্রিষ্টীয় নবম শতকে গুয়েতেমালার পাশাপাশি ইউকাতান অঞ্চলে যখন মায়া সভ্যতার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিলো, তখন মধ্য-মেক্সিকো অঞ্চলের তেইদিহুয়াকান শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আরেক সমৃদ্ধ সভ্যতা। সাম্প্রতিক সময়ের ‘মেক্সিকো সিটি’ ঠিক যেখানে তার থেকে মাইল পঁচিশেক উত্তর-পশ্চিমে এই তেইদিহুয়াকান নগরটির অবস্থান। অন্যদিকে মধ্য-মেক্সিকোতে টোলটেক জাতি বিকাশ ঘটিয়েছিল এন নতুন সভ্যতার। তারা সেখানে তৈরি করে বড় বড় শহর। তাদের রাজধানী ছিল টোলান নগরী যা বর্তমানে টুলা নামে পরিচিত।
মেক্সিকো সিটি নগরী থেকে ষাট মাইল উত্তর-পশ্চিম দিকে টোলান নগরীটির অবস্থান যেখানে নির্মাণ করা হয় বড় দালান-কোঠা, মন্দির ও পিরামিড। তারা মায়াদের অনুকরণে লেখার কৌশল আয়ত্ত করেছিল এবং পঞ্জিকাও তৈরি করতে পারতো।
নগর
বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় আজটেকরা গড়ে তোলে সমৃদ্ধ নগর ও স্থাপত্য। ১০০০ সালের দিকে নহুয়া ভাষায় কথা বলা কয়েকটি জাতির আক্রমণে তাদের সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল। ওখানকার কুলহুয়া জাতির শহর কুলহুয়াকান গড়ে ওঠে টেক্সকোকো হ্রদের দক্ষিণ তীরে। তখন এই হ্রদের পূর্ব তীরে টেক্সকোকো নামে আরেকটি সমৃদ্ধ নগর গড়ে উঠেছিল। তারাও নহুয়া ভাষায় কথা বলত।
কুলহুয়া জাতির মানুষ মধ্য মেক্সিকো অঞ্চলে আজটেক সভ্যতা গড়ে তুলেছিল বলে অনেকের ধারণা। শুরুতে ১০০০ সালের অল্পসময় পরেই ধীরে কুলহুয়া, টেক্সকোকো, টেপানেকসহ অন্যান্য স্থানীয় আদিবাসী গোষ্ঠী মধ্য মেক্সিকো উপত্যকায় মূলত অভিন্ন ধাঁচের সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়েছিল। তাদের গড়ে তোলা এই সমৃদ্ধ সংস্কৃতির পরে নাম দেয়া হয়েছ আজটেক সভ্যতা।
তেরো শতকে টেনোচকা নামে আরেকটি নহুয়া ভাষায় কথা বলা জাতিগোষ্ঠী এসে বসতি স্থাপন করেছিল আজটেকদের এলাকায়। তারাও টেক্সকোকো হ্রদের মাঝখানে একটা দ্বীপে বাস করত। ১৩২৫ সালে তারা তেনোচ্ছেৎলান নামে একটা শহরের পত্তন করে। পরে এই টেনোচকাদেরকে আজটেক নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। ওদের রাজধানী ছিলো তেনোচ্ছেৎলান। আর ঠিক তার ধ্বংসাবশেষের উপরে গড়ে উঠেছে বর্তমান মেক্সিকোর রাজধানী শহর ‘মেক্সিকো সিটি’। আর সেদিক থেকে ধরতে গেলে টেনোচকাদের থেকে আজটেক জাতিগোষ্ঠীর বিকাশ। আর একইভাবে তেনোচ্ছেৎলানের ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আছে ‘মেক্সিকো সিটি’।
উপনিবেশ বিস্তারের সময়ে ১৫১৯ সালের দিকে স্প্যানিশরা মেক্সিকোতে আক্রমণ চালায়। তারপর তারা খেয়াল করেছিল সমগ্র মধ্য মেক্সিকো অঞ্চলের উপর টেনোচকাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। তারা মূলত এই টেনোচকা রাজাদের থেকেই সবথেকে বড় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। তাদের লেখা ইতিহাসে টেনোচকা রাজারা পরিচিতি পেয়েছে আজটেক নামে। বর্তমান সময়েও আজটেক বলতে গেলে টেনোচকা রাজাদের কথাই বলা হয়। আকামাপিচটলি থেকে শুরু করে সেখানে প্রায় ১১ জন রাজা শাসন করেছিলেন।
অর্জন: নানাবিধ যুদ্ধবিগ্রহে বেশির ভাগ সময় পার করলেও বিশ্ব সভ্যতায় আজটেকদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তারা বিশেষ ধরণের ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল। সুদৃশ্য ভাসমান বাগান তৈরির কৃতিত্বও তাদের। তারা প্রশস্ত রাস্তা তৈরির মাধ্যমে নিজেদের শহরগুলোকে সংযুক্ত করেছিল। আজটেকদের ওল্লামাকে (Ollama) বর্তমান বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলা ফুটবল তথা সকারের আদিরূপ হিসেবে মনে করা হয়।
সমাপ্ত