সাধু ভাষা কাকে বলে?

সাধু ভাষা কাকে বলে?

যে ভাষা রীতিতে ক্রিয়া পদ ও সর্বনাম পদ পূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকে, তাকে সাধু ভাষা বলে।

যেমন, জন্মিলে মরিতে হয়, আকাশে প্রস্তর নিক্ষেপ করিলে তাকে ভূমিতে পরিতে হয়, খুন করিলে ফাঁসিতে যাইতে হয়, চুরি করিলে কারাগারে যাইতে হয়, তেমনি ভালবাসিলেই কাঁদিতে হয়। অপরাপরের মতো ইহাও জগতের একটি নিয়ম।


সাধু ভাষা বা সাধুরীতির জন্ম হয় ১৮০০ থ্রিষ্টাব্দের সময়। সে সময় লিখিতভাবে সাধু ভাষা ছিল আরষ্ট ও কৃত্রিম। কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হওয়া মুখের ভাষা ছিল স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত।

কাকে বলবো সাধু ভাষা?

যতদূর জানা যায় ' সাধু ভাষা' শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি ১৮১৫ সালে বেদান্ত গ্রন্থ নামে একটি রচনায়  প্রথম ঐ শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু সাধুভাষা বলতে তিনি বিশেষ কোন্ ধরনের ভাষারীতিকে বুঝিয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। তবে এটুকু বোঝা যায় যাঁরা সংস্কৃতে ব্যুৎপন্ন তাঁদের ভাষাকে বোঝাতে তিনি ব্যবহার করেছিলেন সাধুভাষা শব্দটি। অর্থাৎ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যাঁদের ভাষা ছিল 'সংস্কৃতমূলক' ও 'সংস্কৃতানুসারী' তাঁদের ভাষাকেই রামমোহন চিহ্নিত করেছিলেন সাধুভাষা বলে। 

সাধুভাষার বিপরীতে এখন যে 'চলিত' বা চলতি ভাষার কথা আমরা বলছি, রামমোহনের বেশ পরে বঙ্কিমচন্দ্রের বাঙ্গলা ভাষা নামে একটি প্রবন্ধ সে বিষয়ের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, কিছুকাল পূর্বে দুইটি পৃথক ভাষা বাঙ্গালায় প্রচলিত ছিল। একটির নাম সাধু ভাষা; অপরটির নাম অপরভাষা। একটি লিখিবার ভাষা, দ্বিতীয়টি কহিবার ভাষা। 

সাধুভাষায় অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দ সকল বাঙ্গালা ক্রিয়াপদের আদিম রূপের সঙ্গে সংযুক্ত হইত। যে শব্দ অভাঙ্গা সংস্কৃত নহে, সাধুভাষায় প্রবেশ করিবার তাহার কোন অধিকার ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র ঐ প্রবন্ধে তৎকালীন সাধুভাষাকে আক্রমণ করে বলেছিলেন সংস্কৃতপ্রিয়তা এবং সংস্কৃতানুকারিতা'র কারণেই বাংলা অত্যন্ত নিরস, শ্রীহীন, দুর্বল হয়ে উঠেছে। তাই তার পরামর্শ, অকারনে ঘর শব্দের পরিবর্তে গৃহ, অকারণে মাথার পরিবর্তে মস্তক, অকারণে তার পরিবর্তে পত্র এবং তামার পরিবর্তে তাম্র ব্যবহার উচিত নহে। সাধু ভাষা সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ওইসব মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, ঊনিশ শতকের তৃতীয় দশক পর্যন্ত সাধু ভাষার যে সুনির্দিষ্ট রূপ গড়ে উঠেছিল তাতে তদ্ভব, অর্ধতৎসম প্রভৃতি শব্দের তুলনায় তৎসম শব্দের প্রয়োগ ছিল বেশি। তবে বিদ্যাসাগর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের রচনার মধ্য দিয়ে সাধু ভাষা ক্রমে সংস্কৃতের গণ্ডী বা সংস্কৃত ভাষারীতির অপ্রয়োজনীয় বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে ভাষায় তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন তাকে আজ আমরা নিঃসন্দেহে সাধুভাষা বলে চিহ্নিত করি। কিন্তু তিনি তাঁর শেষ দিককার উপন্যাসগুলোয়, আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪) এবং সীতারাম (১৮৮৬) এ যে সাধু ব্যবহার করেছিলেন তা ক্রিয়াপদের আদিম রূপ ছাড়া অনেকখানিই বর্তমানের চলিত বাংলার পূর্বসুরী হবার যোগ্য।

তবে সাধুভাষা বাংলাভাষীদের মুখের ভাষা অনেক কাছাকাছি চলে আসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধু গদ্যরীতির মাধ্যমে। তিনি ১৯১৪ সালের আগে চলিত ভাষা ব্যবহার করেননি একথা তথ্য হিসাবে সত্য হলেও চলিত বাংলা বা কথ্য বাংলার অনেক কাছাকাছি এসে গিয়েছিল তাঁর গদ্যভঙ্গি। ক্রিয়াপদের ও সর্বনামের আদিম রূপ হয়তো রবীন্দ্রনাথের ১৯১৪ সালের আগেকার গদ্যে ব্যবহৃত হয়েছে কিন্তু তার প্রকাশভঙ্গি অনেক বেশি চলিত বাংলার নিকটবর্তী। ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের রীতি প্রতিষ্ঠার সময় বাংলা সাহিত্যিক গদ্য অবলম্বন করেছিল সংস্কৃত ভাষার আদর্শ অর্থাৎ সংস্কৃত রীতির শব্দ চয়ন, সমাস-বাহুল্য, কথ্য ভাষার পদ বর্জন রীতি। ঐ শতাব্দীর পণ্ডিতেরাই এ ধরনের ভাষা রীতির নাম দিয়েছিলেন সাধুভাষা। এখানে বলে রাখা দরকার যে সাধু ভাষা কখনোই মানুষের কথাবার্তার ভাষা ছিল না, এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল কেবল সাহিত্য রচনার মধ্যেই।

আরো পড়ুনঃ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url