লিঙ্গের ধারণা | লিঙ্গ কাকে বলে?

লিঙ্গের ধারণা (Concept of Gender) দাও।

যেকোনো ভাষায় ব্যবহৃত বিশেষ্য পদগুলি শ্রেণিবিভাগ করার অন্যতম ভিত্তি লিঙ্গ। পুংলিঙ্গ (পুং অর্থাৎ পুরুষ, Masculine Gender), স্ত্রীলিঙ্গ (Feninine Gender) এবং ক্লীবলিঙ্গ (Neuter Gender)- এই তিনটি শ্রেণির সঙ্গে ছোটোবেলা থেকেই আমাদের পরিচিতি ঘটে। কিন্তু তারও পূর্বে ছোটোরা তার চারপাশের মানুষজনকে ছেলে (পুরুষ) এবং মেয়ে (নারী) এই হিসেবে ভাগ করে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এই শ্রেণিকরণ এতটাই স্বাভাবিকভাবে আয়ত্ত হয় যে তা নিয়ে কখনোই কোনো প্রশ্ন দেখা যায় না। নিজেকে শিশু যে শ্রেণিভুক্ত বলে জানে সেই শ্রেণির সঙ্গেই বিনা প্রশ্নে একাত্মবোধ করে নিয়ে নিজেকে গড়ে তোলে। কিন্তু প্রশ্ন একটি থাকেই, লিঙ্গ কাকে বলে?

লিঙ্গ কাকে বলে?

ইংরেজি ভাষায় Gender এবং Sex এই দুটি শব্দ সমার্থক ধরে নিয়ে নির্বিচারে একটির পরিবর্তে অপরটি ব্যবহার করা হয়। বাংলায় Gender কথাটির স্বীকৃতি প্রতিশব্দ লিঙ্গ হলেও, সমস্যা দেখা দেয় Sex কথাটিকে নিয়ে। তার কারণ সবদিক বিচার করে একটি সাধারণ সিদ্ধান্ত সকলেই নিয়ে থাকেন যে Gender এবং Sex এক নয়। অতএব, দুটি ভিন্ন প্রতিশব্দ থাকা উচিত। অভিধানে 'যোনি' শব্দটির অর্থ লেখা হয়েছে উৎপত্তিস্থল, স্ত্রীজননাঙ্গ। সেখান থেকেই যৌন (Sexual), যৌনতা (Sexuality) ইত্যাদির শব্দের সৃষ্টি। কিন্তু Sex শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে কোনো বিশেষ্য পদ সম্ভবত নেই। ইংরেজিতে পুরুষ হয় সেখানে বাংলায় লিঙ্গ (Gender) ছাড়া আর কিছু লেখা হয় না। অথচ বর্তমান আলোচ্য বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে Sex এবং Gender-এর পার্থক্য একটি প্র্রধান বিচার্য বিষয়। অতএব, জটিলতা পরিহার করার জন্য সরাসরি সেক্স (Sex) কথাটি ব্যবহার করাই শ্রেয় বলে মনে হয়। আরও একটি কারণ, লিঙ্গ নামক ধারণাটির সংজ্ঞা দিতে হলে সেক্স কথাটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

লিঙ্গের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে নানা বিতর্ক আছে। বিশেষভাবে আধুনিক পৃথিবীতে নরনারীর শ্রেণিবিভাগে, যারা এই দুই শ্রেণির কোনোটিতেই পড়েন না, তাঁরাও সমস্ত রকম প্রাপ্য অধিকার ও সুবিধাসহ (Rights and Priviledges) নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত। যেমন, লিঙ্গের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে।

"কোনো একটি কৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে একজন ব্যক্তির প্রাকৃতিক নারীত্ব বা পুরুষত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্ত বৈশিষ্ট্য, আচরণ, ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতার সমষ্টিই লিঙ্গ। লিঙ্গ পার্থক্যের ভিত্তি হতে পারে জৈবিক, শিখন প্রসূত অথবা এই দুয়ের এক সমন্বয়।

যদিও Gentile (1993), Unger এবং Crawford (1993) প্রমুখ লিঙ্গ গবেষকগণ এই সংজ্ঞার সঙ্গে একমত নন, তবুও উপরোক্ত সংজ্ঞায় লিঙ্গ সম্পর্কিত একটি দৃষ্টিভঙ্গি এবং সেই সঙ্গে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

প্রথমত, নারীত্ব বা পুরুষত্ব অর্থাৎ সেক্স নির্ধারিত হয় জৈবিক কারণে, কিন্তু লিঙ্গ জৈবিক ও শিখন প্রসূত একটি মানসিক গঠন। যদিও মানসিক গঠনের কথা সংজ্ঞায় সরাসরি বলা হয়নি, তবুও উক্ত সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। কারণ, জৈব-মানসিক বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতা, আচরণের বৈশিষ্ট্য এবং সবকিছুই একটি বিশেষ কৃষ্টির পটভূমিতে, মিলিতভাবে একটি মানসিক গঠনের প্রতিই ইঙ্গিত করে। নারীত্ব ও পুরুষত্বকে যদি নানা উপাদানের সমন্বিত একটি মানসিক গঠন হিসেবে চিন্তা করা যায় তবে তার তাৎপর্য আরও গভীর হয়ে ওঠে। অঙ্গসংস্থানগতভাবে এবং শারীরবৃত্তীয়ভাবে একজন ব্যক্তি নারী বা পুরুষ হিসেবে গণ্য হলেও তার মানসিক গঠন সম্পূর্ণরূপে নারী বা পুরুষের অনুরূপে না হতেও পারে, অন্তত যতটা ব্যতিক্রম কোনো একটি কৃষ্টি অনুমোদন করে। সেই কারণে পাশ্চাত্য সমাজের সঙ্গে ভারতীয় সমাজের নারীত্ববোধ প্রসঙ্গে কখনো-কখনো কিছু পার্থক্য দেখা যায়।

দ্বিতীয়ত, লিঙ্গ সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্য জৈবিক কারণে সৃষ্টি হতে পারে (যেমন, স্ত্রী হরমোন ইস্ট্রোজেন অথবা পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরনের প্রভাব)। আবার শিখনের ফলেও উক্ত বৈশিষ্ট্য অর্জিত হতে পারে। প্রত্যেক সমাজেই ছোটোবেলা থেকে শিশুপালনের ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়ের পৃথক ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করার প্রয়াস দেখা যায়। তার ফলে ছেলে ও মেয়ের সামাজিক অভিজ্ঞতার পার্থক্য ঘটে। এই পার্থক্য খেলাধুলা, বিনোদন, দায়িত্ব-কর্তব্য ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রকটিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যও সেইভাবেই প্রকাশ পায়। এই বিষয়টির তাৎপর্য এই যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে যে সমস্ত আচরণগত ও অন্যান্য পার্থক্য দেখা যায় তার সবটাই সর্বজনীন এবং অনিবার্য নয়। তার অনেকটাই আরোপিত।

তৃতীয়ত, লিঙ্গ সম্পর্কিত ব্যক্তিগত বোধ বা ধারণা এবং সর্বজনীন সামাজিক ধারণা, দুয়ের ক্ষেত্রেই কৃষ্টির ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে লিঙ্গের সংজ্ঞাতে কৃষ্টির প্রসঙ্গটি সর্বাগ্রে উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষ হিসেবে একজন ব্যক্তির সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থান, দায়িত্ব-কর্তব্য, আচরণ ইত্যাদির নির্দিষ্ট ধারণা ছাড়াও নারী বা পুরুষ হিসেবে কিছু স্বতন্ত্র ধারণা প্রত্যেক কৃষ্টিতেই নির্দিষ্ট আছে। আবার এই দুই ধারণার মধ্যেকার পার্থক্য ও সম্পর্কও এক এক কৃষ্টিতে আলাদা রকম। অবশ্য সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিবর্তনও ঘটে। সেই কারণে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের নারী-পুরুষের ধারণায় পার্থক্য দেকা যায়, বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক কৃষ্টিতে, জনজাতির কৃষ্টিতে লিঙ্গ সম্পর্কিত ধারণায় পার্থক্য থাকতে পারে।

চতুর্থত, লিঙ্গ সম্পর্কিত ধারণা যথেষ্ট জটিল। তার প্রাথমিক ভিত্তি জৈবিক কারণে সৃষ্ট স্বাভাবিক নারীত্ব বা পুরুষত্ব, অর্থাৎ সেক্স (Sex)। কিন্তু বহু সমাজে শিশুদের মধ্যে তার জৈবিক পরিচয় সম্বন্ধে সচেতনতা বিকাশ হওয়ার পূর্ব থেকেই শিশুপালনের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিচয় সৃষ্টির প্রয়াস শুরু হয়ে যায়। এমনকি বাঞ্ছিত লিঙ্গের সন্তান ও অবাঞ্ছিত লিঙ্গের সন্তানের প্রতি পিতামাতার যে আপেক্ষিক পক্ষপাতিত্ব, নানাভাবে তার পরোক্ষ প্রকাশ ঘটে সন্তান পালনের মধ্য দিয়ে। এর ফলে পুত্র-সন্তান ও কন্যা-সন্তানের আচরণ, ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য, অভিজ্ঞতা যতটা তার জৈবিক পরিচয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তার চেয়েও বেশি নিয়ন্ত্রিত হয় পিতামাতা ও চারপাশের অন্যান্য  মানুষের আচরণ দ্বারা। সুতরাং এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন লিঙ্গ সম্পর্কিত ধারণার কারণগুলি সঠিক কী কী?

সবশেষে, উপরোক্ত সংজ্ঞায় যে শিখনের কথা বলা হয়েছে তা প্রথাগত এবং প্রথাহীন দুই রকম হতে পারে। প্রথাহীন বলতে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, পরিবারে বা তার বাইরে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে শেখার (যেমন, মেয়েরা মাকে দেখে অনেক কিছু শেখে যা তার লিঙ্গবোধের অঙ্গীভূত হয়ে যায়) কথা বোঝানো হয়েছে। আর প্রথাগত শিক্ষা তখনই হতে থাকে যখন ছেলেদের ও মেয়েদের পাঠক্রমে ভিন্ন ভিন্ন উপাদান সন্নিবেশিত হয় অথবা মেয়েদের জন্য আলাদা সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি নির্দিষ্ট হয়। অর্থাৎ এক কথায় লিঙ্গ সম্পর্কিত অর্জিত যে ধারণা তা শুধুমাত্র নিষ্ক্রিয় পন্থায় আয়ত্ত হয় না, সক্রিয় প্রচেষ্টাও তার জন্য দায়ী। 

লিঙ্গ সম্পর্কিত আরও কয়েকটি ধারণা ও সংজ্ঞা সম্বন্ধে উল্লেখ না করলে প্রসঙ্গটি অসম্পূর্ণ থাকবে এবং লিঙ্গের ধারণা যে সমস্ত উপাদান দ্বারা নির্মিত সে বিষয়টিও বোঝা কঠিন হবে।

আরো পড়ুনঃ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url