পরিযান কাকে বলে? পরিযানের গমনপথ এবং পরিযানের গুরুত্ব

শীতের পাখির মাইগ্রেশন বা পরিযান কি?

ঋতুগতভাবে পরিবর্তনশীল পরিবেশ মোকাবিলায় প্রাণী যে সব কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে তারই একটি হচ্ছে মাইগ্রেশন (migration) বা পরিযান

প্রকৃত অর্থে পরিযান বলতে উভয়মুখি চলাচলকে বুঝায় অর্থাৎ স্থায়ী বাসভূমি থেকে নতুন কোনো অনুকূল পরিবেশে যাত্রা এবং সেখানে সাময়িক বসবাসের পর পুনরায় স্থায়ী বসতিতে প্রত্যাগমন।

এরকম যাতায়াত সাধারণত একই পথ অনুসরণ করে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে সংঘটিত হয়। পাখির পরিযান এধরনের। পাখির জগতে পরিযান ব্যাপক বিস্তৃত। প্যালিআর্কটিক অঞ্চলের ৪০ শতাংশ পাখি-প্রজাতি পরিযায়ী। পাখিদের পরিযান বিজ্ঞানীদের কাছে আজও রহস্যাবৃত ঘটনা, তবে যে কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ উল্লিখিত হয়েছে তা হচ্ছে - খাদ্যের স্বল্পতা, শীতের তীব্রতা, পূর্বপুরুষীয় বাসভূমিতে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি।

স্থানীয় পরিযান সাধারণত কয়েকশ ফুট থেকে ১ - ২ মাইল পর্যন্ত হয়, যেমন: হিমালয়ান পাট্রিজ (একধরনের তিতির)। অন্যদিকে, আর্কটিক টার্ণ ১১ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে শীতকালে অ্যান্টার্কটিকার পার্ট্রিজ (একধরনের তিতির)। 

অন্যদিকে, আর্কটিক টার্ণ ১১ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে শীতকালে অ্যান্টার্কটিকার উপকূলে এসে হাজির হয়। কিছু পাখি মাটির সামান্য উপর দিয়ে উড়ে গেলেও সুশৃঙ্খল পরিযানের অংশগ্রহণকারী পাখি মাটি থেকে প্রায় ৩ হাজার থেকে ২০ হাজার ফুট উচ্চতায় আন্দিজ ও হিমালয় পর্বতকেও অতিক্রম করে যায়।

পাখিরা সাধারণত একদিনে ৫ - ৬ ঘণ্টা উড়বার পর খাদ্য ও পানীয়ের জন্য বিশ্রাম নেয়, কিন্তু গোল্ডেন প্লোভার পাখির বিরতিহীনভাবে উড়ে ১৪০০ মাইল দূরবর্তী দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছার প্রমাণ আছে। পরিযানের সময় পাখিরা সুশৃঙ্খল রীতি মেনে চলে। 

প্রথমে বয়স্ক পাখিরা পরিযায়ী হতে শুরু করে, পরে স্ত্রী ও তরুণরা অনুসরণ করে। ফিরতি অভিযানে তরুণরাই নেতৃত্ব দেয় বলে জানা গেছে।

পরিযানের নিয়ম ও সময় সব সময় ঠিক থাকে। অস্বাভাবিক আবহাওয়ায় কিছুটা ব্যতিক্রম না ঘটলে কিছু প্রজাতির পরিযান - সময় ও শীতভূমি পরিত্যাগ - সময় বছরের পর বছর প্রায় একই থাকে, দুএকদিন এদিক - ওদিক হতে পারে। তা ছাড়া, পাখিরা সব সময় একই পথ ধরে পরিযায়ী হয় এবং ঠিক আগের জায়গায় গিয়ে পৌঁছে।

পরিযানের গমনপথ

পরিযায়ী পাখিরা নিজস্ব গমনপথ ধরে এগিয়ে চলে। এ পথ অনেক সময় একই থাকে। পাখির বিভিন্ন গমন পথের মধ্যে রয়েছে সমুদ্র, উপকূলীয় নদী ও নদী - বিধৌত ভুখন্ড ও পার্বত্য পথ।

সমুদ্র পথ সাধারণত সামুদ্রিক পাখিরা ব্যবহার করে। কিন্তু স্থলচর পাখি সমুদ্র পথে ৪০০ মাইল পর্যন্ত অতিক্রম করে যায়, কিন্তু মধ্যবর্তী কোন স্থানে দ্বীপ থাকলে তারা আরও বেশি পথ অতিক্রম করতে পারে। বিশেষ করে জলচর পাখিরা উপকূলীয় পথ ধরে পরিযায়ী হয়। সমতল থেকে পাহাড়ে এবং পাহাড় থেকে সমতলে গমনাগমনের সময় পরিযায়ী পাখি নদী ও নদীবিধৌত ভূখণ্ডকে গমনপথ হিসেবে বেছে নেয়। 

এশিয়ার বড় নদীগুলো পরিযানের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। খুব কম পাখিই পর্বত অতিক্রম করে। পর্বতগুলো পরিযায়ী পাখিদের নির্দেশক চিহ্ন হিসেবে কাজ করে, তবে কিছু জলচর পাখিতে হিমালয় পর্বত অতিক্রম করতেও দেখা যায়। ঐ পাখিদের জন্য এটি একটি গমন পথ।

পরিযানের গুরুত্ব

উপকারী ভূমিকাঃ মাইগ্রেশনের ফলে পাখি আবহাওয়ার প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা পায়; বিচিত্র ও পর্যাপ্ত আহার পায় এবং পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগীতা হ্রাস পায়; গ্রীষ্মে স্বদেশ ভূমিতে এসে উপযোগী ও নিষ্কন্টক জনন ক্ষেত্র ফিরে পায়, কম কষ্টে পর্যাপ্ত আহার পায়, তখন জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে। বিভিন্ন প্রজাতির মিলনে জিন সংযুক্তির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

অপকারী ভূমিকাঃ মাইগ্রেশন পাখির জন্য বেশ বিরূপ প্রভাব ফেলে, যেমন- অনেক সময় বিরতিহীন ভ্রমণে ক্লান্ত অসংখ্য পাখি সমুদ্রে পড়ে মরে যায়; আবহাওয়া আকস্মিক পরিবর্তনে, যেমন - প্রবল বর্ষণ, তুষারপাত ও ঝড়ে পড়ে বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী পাখি মৃত্যুবরণ করে; তরুণ পাখিরা দূর পরবাসে অনেক প্রাকৃতিক শত্রুর মুখোমুখি হয়; বৈদ্যুতিক তার ও লাইট হাউজ ছাড়াও অগনিত পাখি মানুষের শিকারে পরিণত হয়; এবং মানুষের শিকারে পরিণত হয়ে অকালে প্রাণ হারায়।

বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখি

বাংলাদেশ প্রধানত শীতকালে পরিযায়ী পাখির আগমনে মুখরিত থাকে। সারা বছরই পরিযায়ী পাখির আনাগোনা অব্যাহত থাকে। এসব পাখি দেশের পাখি হতে পারে, আবার বিদেশিও হতে পারে। সময়কাল ভেদে এগুলো গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন পাখি নামে পরিচিত। কিছু পাখি আছে যা অন্যদেশে যাওয়ার আগে দু'একদিন বাংলাদেশে অবস্থান করার পর নির্দিষ্ট দেশে উড়াল দেয়। এসব পাখি ট্রানসিয়েন্ট পরিযায়ী।

বাংলাদেশে যে সব বিদেশি পাখি পরিযায়ী হয় তার বেশির ভাগ আসে হিমালয় ও তার বাইরে থেকে। অনেক প্রজাতির আগমন ঘটে ইউরোপ ও দূরপ্রাচ্য (যেমন সাইবেরিয়া) থেকে। অর্থাৎ ইউরেশিয়া থেকে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ায় শীতে পাখি পরিযায়ী হয়। শরৎ ও বসন্তকালেও কিছু পাখির যাতায়াত চোখে পড়ে। আর দেশি পাখির পরিযান সারা বছরই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হতে থাকে।

বাংলাদেশে প্রায় ৫০০ হাজার প্রজাতির স্থায়ী পাখি রয়েছে, অস্থায়ী বা বিদেশি পাখি প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৩০০। অনেক বিদেশি পরিযায়ী স্বাচ্ছন্দে কাটিয়ে যায় (যেমন-Spoon-billed Sandpiper)। বাংলাদেশে হাঁস, রাজহাঁসসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলচর পাখিসহ অসংখ্য শিকারি পাখিও (চিল, বাজ) পরিযায়ী হয়।

এসব পাখি দেশের বড় বড় হাওড়, নদী ও উপকূল জুড়ে বিস্তুত থাকে। লক্ষ লক্ষ সদস্যের দৃশ্যমান পরিযায়ী পাখির পাশাপাশি অদৃশ্য পতঙ্গভুক্ত পাখিরা বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। অক্টোবর-মার্চ মাস পর্যন্ত মাইগ্রেটরি পাখি দেখার ধূম পড়ে যা। সমস্ত হাওর এলাকা পরিযায়ী পাখির জন্য সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে, আইনে বিশেষ বিধান করে এগুলো সুরক্ষারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

শেষকথা, পাখি প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টি। এদের পরিযান হচ্ছে একদিকে প্রাণিজগতের অন্যতম সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ, অন্যদিকে অন্যতম রহস্যময় ঘটনা। শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ তা অবলোকন করেছে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছে। একবিংশ শতাব্দীতেও এর রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয় নি। কিসের আশায় ও কিসের নেশায় পাখি পরিযায়ী হয়, প্রাকৃতিক নির্বাচনের সেই নিগুড় রহস্য উন্মোচন করতে পারলে হয়তো মানব প্রজাতিও তা কাজে লাগাতে পারবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url