আয়নিক ও সমযোজী যৌগের বৈশিষ্ট্য

আয়নিক ও সমযোজী যৌগের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Ionic and Covalnet Bonds)

ক) গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক (Melting Point and Boiling Point)

যে যৌগে আয়নিক বন্ধন থাকে সেই যৌগকে আয়নিক যৌগ বলা হয় এবং যে যৌগে সমযোজী বন্ধন থাকে সেই যৌগকে সমযোজী যৌগ বলা হয়।

আয়নিক যৌগের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক অনেক বেশি হয় কিন্তু সমযোজী যৌগের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক আয়নিক যৌগ অপেক্ষা কম হয়। কিন্তু কেন?

এটি আসলেই সত্যি আয়নিক যৌগে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধান থাকে। এ আধানদ্বয় পরস্পরের সাথে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে। আয়নিক যৌগে এরূপ অসংখ্য ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধান পরস্পরের কাছাকাছি থেকে ত্রিমাত্রিকভাবে সুবিন্যস্ত হয়ে একটি স্ফটিক তৈরি করে। এতে তাদের আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল অনেক বেশি হয়। ফলে এদেরকে একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে বা গলিয়ে ফেলতে অনেক বেশি তাপ শক্তির প্রয়োজন হয়। কাজেই এদের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক অনেক বেশি হয়।

অপর দিকে সমযোজী অণুসমূহের মধ্যে আন্তঃআণবিক আকর্ষণ মূলত দুর্বল ভ্যান্ডারওয়ালস বলের কারণে হয়ে থাকে। কাজেই সমযোজী যৌগে আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল অনেক কম হয়। এজন্য এদেরকে সামান্য তাপ প্রদান করলে এরা পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। অর্থাৎ এদের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক কম হয়। একইভাবে তোমরা আয়নিক যৌগ NaCl এর পরিবর্তে CuSO4, NaNO3, KCl, CaCl2 ইত্যাদি ব্যবহার করলেও একই বিষয় দেখবে।

অন্যদিকে সমযোগী যৌগ হিসেবে গ্লুকোজ, চিনি ইত্যাদি ব্যবহার করে পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করতে পার। স্ফুটনাঙ্কের ক্ষেত্রে সমযোজী যৌগ হিসেবে আমাদের অতি পরিচিত পানি ব্যবহার করা যায়। সব পরীক্ষাতেই দেখতে পাবে আয়নিক যৌগের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক সমযোজী যৌগ থেকে অনেক বেশি।

খ) দ্রাব্যতা / দ্রবণীয়তা (Solubility)

সকল আয়নিক যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হয় কিন্তু কিছু কিছু আয়নিক যৌগ আছে যেমনঃ সিলভার ক্লোরাইড পানিতে দ্রবীভূত হয় না। অপরদিকে, সমযোজী যৌগ যেমনঃ ন্যাপথালিন, সরিষার তেল, কেরোসিন এগুলো নিয়ে একইভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করলে দেখতে পাবে এদের কেউই পানিতে দ্রবীভূত হয়নি।

সমযোজী যৌগ সাধারণত পানিতে দ্রবীভূত হয় না তবে কিছু কিছু সমযোজী যৌগ আছে যেমনঃ চিনি, গ্লুকোজ, অ্যালকোহল এগুলো পানিতে দ্রবীভূত হয়। সুতরাং সামগ্রিকভাবে বলা যায় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সকল আয়নিক যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হয় এবং কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সকল সমযোজী যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হয় না।

অধিকাংশ সমযোজী যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হয় না - তবে কিছু কিছু সমযোজী যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হয়, এর কারণ কী?

এর কারণ জানতে হলে প্রথমে পানির বন্ধন গঠন সম্পর্কে জানতে হবে। পানি একটি সমযোজী যৌগ অর্থাৎ পানির অণুতে একটি অক্সিজেন পরমাণুর সাথে দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে অধিক তড়িৎ ঋণাত্মক হওয়ায় পানির অণুর সমযোজী বন্ধনীতে ব্যবহৃত ইলেকট্রন দুটি অক্সিজেনের দিকে সামান্য পরিমাণ সরে যায়।

যে কারণে অক্সিজেন পরমাণু আংশিক ঋণাত্মক আধান ও হাইড্রোজেন পরমাণু আংশিক ধনাত্মক আধান প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ পানির অণুতে আংশিক ধনাত্মক আধান প্রাপ্ত হয়। 

অর্থাৎ পানির অণুতে আংশিক ধনাত্মক এবং আংশিক ঋণাত্মক প্রান্তের সৃষ্টি হয়। এরকম ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধানপ্রাপ্ত সমযোজী যৌগকে পোলার সমযোজী যৌগ বলে।

সুতরাং পানি একটি পোলার সমযোজী যৌগ এবং দ্রাবক হিসেবে পানি পোলার দ্রাবক। মনে রাখবে, সমযোজী বন্ধনীস্থ ইলেকট্রন যুগলকে কোনো পরমাণু কর্তৃক নিজের দিকে আকর্ষণ করার ক্ষমতাকে উক্ত পরমাণুর তড়িৎ ঋণাত্মকতা বলা হয়।

+δ (প্লাস ডেলটা) ও -δ (মাইনাস ডেলটা) দিয়ে যথাক্রমে আংশিক ধনাত্মক আধান এবং আংশিক ঋণাত্মক আধানকে বোঝানো হচ্ছে।


পোলার দ্রাবক পানিতে আয়নিক যৌগ যোগ করলে পানির অণুগুলোর ধনাত্মক প্রান্ত আয়নিক যৌগের ঋণাত্মক প্রান্ত বা অ্যানায়নকে আকর্ষণ করে। একইভাবে পানির অনুর ঋণাত্মক প্রান্ত আয়নিক যৌগের ধনাত্মক প্রান্ত বা ক্যাটায়নকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণ বলের মান যখন আয়নিক যৌগের অ্যানায়ন ও ক্যাটায়নের মধ্যকার আকর্ষণ বল থেকে বেশি হয় তখন অ্যানায়ন ও ক্যাটায়ন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পানির অণু দিয়ে পরিবেষ্টিত হয়। এভাবে আয়নিক যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হয়।

NaCl আয়নিক যৌগ তাই NaCl পোলার দ্রাবক H2O তে দ্রবীভূত হয়। মিথানল (CH3OH) পোলার যৌগ তাই CH3OH পোলার দ্রাবক H2O তে দ্রবীভূত হয়। মিথেন (CH4) আয়নিক যৌগও নয় আবার CH4 পোলার যৌগও নয়, কাজেই CH4 পানিতে দ্রবনীয় হয় না।

অপরদিকে, সমযোজী যৌগে সাধারণত আয়নিক যৌগের মতো ধনাত্মক ও ঋণাত্মক প্রান্ত থাকে না। তাই পানির অণুর ধনাত্মক ও ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে সমযোজী যৌগের কোনো আকর্ষণ বা বিকর্ষণ ঘটে না। ফলস্বরূপ সমযোজী যৌগটি পানিতে আয়ন আকারে ভেঙ্গে যায় না অর্থাৎ সমযোজী যৌগটি পানিতে দ্রবীভূত হয় না।

তবে কিছু কিছু সমযোজী যৌগ আছে যাদের মধ্যে আংশিক এবং আংশিক ঋণাত্মক প্রান্ত দেখা যায় অর্থাৎ পোলারিটি দেখা যায়। যেমনঃ ইথানল (C2H5OH) পোলার যৌগ তাই ইথানল পানিতে দ্রবীভূত হয়।

গ) বিদ্যুৎ পরিবাহিতা (Electrical Conductivity)

একটি বিকারে খাদ্য লবণের (NaCl) জলীয় দ্রবণ এবং অন্য একটি বিকারে চিনির জলীয় দ্রবণ নাও। এবার উভয় দ্রবণে ইলেকট্রোড হিসেবে দুটি গ্রাফাইট দণ্ড কিংবা যেকোনো ধাতব দণ্ড ডুবিয়ে দণ্ডদ্বয়ের সাথে ছবিতে দেখানো উপায়ে ব্যাটারি এবং বাল্ব যুক্ত করে বর্তনী পূর্ণ করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

দেখা যাবে যে, খাদ্য লবণের দ্রবণযুক্ত বর্তনীতে বাল্ব জ্বলছে কিন্তু চিনির জলীয় দ্রবণযুক্ত বর্তনীতে বাল্ব জ্বলছে না। অর্থাৎ খাদ্য লবণ বা NaCl এর জলীয় দ্রবণ বিদ্যুৎ পরিবহন করে কিন্তু চিনির জলীয় দ্রবণ বিদ্যুৎ পরিবহন করে না। এ থেকে মন্তব্য করা যায় যে, জলীয় দ্রবণে বিদ্যুৎ পরিবহন করে কিন্তু সমযোজী যৌগ জলীয় দ্রবণে বিদ্যুৎ পরিবহন করে না।


কিন্তু এর কারণ কী?

এর কারণ অনুমান করা যায় যে, বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য প্রয়োজন বিচ্ছিন্ন ধনাত্মক বা ঋণাত্মক আয়ন। খাদ্য লবণের (NaCl) জলীয় দ্রবণে ধনাত্মক আয়ন হিসেবে Na+ ও ঋণাত্মক আয়ন হিসেবে Cl- বিদ্যুৎ পরিবহন করে।

যেহেতু জলীয় দ্রবণে আয়নিক যৌগসমূহ বিচ্ছিন্ন ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়ন হিসেবে অবস্থান করে কাজেই সকল আয়নিক যৌগ জলীয় দ্রবণে বিদ্যুৎ পরিবহন করে।

অপরদিকে জলীয় দ্রবণে সমযোজী যৌগ বিদ্যুৎ পরিবহন করে না। কারণ সমযোজী যৌগ কোনো বিচ্ছিন্ন আয়ন তৈরি করে না। আর দ্রবণে আয়ন না থাকলে তা কখনই বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারবে না।

CaCl2 দ্রবণে Ca2+ ও Cl- থাকে। HCl দ্রবণে H+ ও Cl- থাকে। কাজেই এরা দ্রবণে বিদ্যুৎ পরিবহন করে। গ্লুকোজ (C6H12O6) দ্রবণে আয়ন আকারে বিভক্ত হয় না, কাজেই গ্লুকোজ দ্রবণে বিদ্যুৎ পরিবহন করে না।


এসএসসি || রসায়ন || SSC || Chemistry

অধ্যায় - ০২ : পদার্থের অবস্থা
অধ্যায় - ০৩ : পদার্থের গঠন
অধ্যায় - ০৪ : পর্যায় সারণি
অধ্যায় - ০৫ : রসায়নিক বন্ধন
অধ্যায় - ০৬ : মোলের ধারণা ও রাসায়নিক গণনা
অধ্যায় - ০৭ : রাসায়নিক বিক্রিয়া
অধ্যায় - ০৮ : রসায়ন ও শক্তি
অধ্যায় - ০৯ : এসিড-ক্ষারক সমতা
অধ্যায় - ১০ : খনিজ সম্পদ ধাতু-অধাতু
অধ্যায় - ১১ : খনিজ সম্পদ- জীবাশ্ম
অধ্যায় - ১২ : আমাদের জীবনে রসায়ন
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url