শিখন দক্ষতার বিকাশসাধন (Developing Teaching Skills)

শিখন দক্ষতার বিকাশসাধন (Developing Teaching Skills)

বিভিন্ন ধরনের শিক্ষণ দক্ষতাগুলিকে নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ

শিখন দক্ষতার বিকাশসাধন

পাঠ উপস্থাপনের দক্ষতা (Skill of Introducing a Lesson)

একটি পাঠদানের কার্যকারিতা ও অগ্রগতি নির্ভর করে বিষয়বস্তু কতটা নৈপুণ্যতার সঙ্গে উপস্থাপিত হল তার উপর। হার্বার্টীয় পঞ্চম সোপানটির প্রথম সোপনটি হল - প্রস্তুতি বা Presentation, যেখানে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পূর্বজ্ঞানের ভিত্তিতে নতুন পাঠের আগ্রহ সঞ্চারণের উদ্দেশ্য অভিনয়, কবিতার উদ্বৃতি, গান শোনানো এবং তার সঙ্গে প্রশ্নোত্তর ইত্যাদি ব্যবস্থা অবলম্বন করেন।

এই বিষয়ক দক্ষতার কয়েকটি সাহায্যকারী উপাদান হলো-

মনোযোগ আকর্ষণ শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে এমন ব্যবস্থা করবেন, যাতে শ্রেণিকক্ষের সকল শিক্ষার্থী পাঠের প্রতি মনোযোগী হয়।
প্রেষণার স্তর অনুধাবন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের একটি সুনির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত প্রেষণার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে। এরপর প্রেষণার আরোহণ-অবরোহণ ঘটে।
পূর্বজ্ঞান ও অভিজ্ঞার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এটি মনোযোগ আকর্ষণ ও প্রেষণাকে বজায় রাখতে সাহায্য করে।
প্রধান বক্তব্য চিহ্নিতকরণ যখন একটি পাঠ শুরু হয়, তখন পাঠের অন্তর্গত মূল অংশগুলি উল্লেখ করা হলে, শিক্ষার্থীরা পাঠের বিষয়ের প্রতি আগ্রহী হয়।
উপযুক্ত প্রদীপনের ব্যবহার উপযুক্ত উদ্ধৃতি, উদাহরণ, চার্ট, মডেল, ছবি, টেপরেকর্ডার, প্রোজেক্টর প্রভৃতি ব্যবহার করে পাঠ্য বিষয়কে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।

প্রশ্নকরণের দক্ষতা (Skill of Questioning)

পাঠদানকে সার্থক রূপদানের জন্য প্রশ্নের ভূমিকা যথেষ্ট। তাই শ্রেণিতে পাঠদানের সময় নানান প্রশ্নের অবতারণা করতে হয়, এই প্রশ্নাবলি জিজ্ঞাসাকরণের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্দেশ্য সাধিত হয়।

এই বিষয়ক দক্ষতার কয়েকটি সাহায্যকারী উপাদান হলো -

এই বিষয়ক দক্ষতার কয়েকটি সাহায্যকারী উপাদান হলো-

ভাষার যথার্থতা ও সারল্য শিক্ষার্থীদের সহজ-স্পষ্ট ভাষায় নির্ভলভাবে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে হবে। উপযুক্ত ভাষার ব্যবহার, সময় বাঁচাতে ও উদ্দেশ্যপূরণে সাহায্য করে।
শিখনের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন শিক্ষণীয় বস্তুর সঙ্গে ভাষা ব্যবহারের সংগতি থাকা বিশেষ প্রয়োজন। শিক্ষণের দ্বারা শিখনের উদ্দেশ্য অনুযায়ী ভাষার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
পুনরালোকপাত ও পুনঃনির্দেশ প্রশ্নের উত্তর কাঙ্খিতভাবে না এলে প্রশ্নটিকে আরও সরলভাবে উপস্থাপন করতে হবে। অথবা পরিচিত প্রসঙ্গ দিয়ে প্রশ্নের অবতারণা করা দরকার। এই প্রশ্নের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীদের উদ্দীপিত ও উজ্জীবিত করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের উত্তরের সাপেক্ষে পরবর্তী প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের উত্তরদানের গতিপ্রকৃতি থেকে পরবর্তী প্রশ্নে চলে যেতে হবে। সঠিক উত্তরদানের জন্য শিক্ষককে সাহায্য করতে হবে।
উত্তরদানের সহায়ক তথ্য যদি কোনো শিক্ষার্থী বিষয়টিকে যথাযথ বুঝতে পেরেও উত্তরটি সঠিকভাবে দিতে না পারে এমন হয় - সেক্ষেত্রে শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের মূল বিষয়টা একটু ধরিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক প্রয়োজন বোধে প্রশ্নটি একটু সহজ করে দিতে পারেন বা ভেঙে দিতে পারেন।

শিক্ষণ উপকরণ ব্যবহারের দক্ষতা (Skill of Using Teaching Aids)

শিক্ষণ শুধুমাত্র মুখে মুখে তথ্য আদান-প্রদান নয় বরং বিদ্যালয়ের প্রধান আকর্ষণীয় বিষয় বা জানার স্তর। শিক্ষণ পদ্ধতি এমন হবে যেখানে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়েই তৃপ্তিদায়ক স্তরে থেকে জ্ঞান আত্তীকরণ করবে। শিক্ষা সম্পূর্ণ করার জন্য তাই বিভিন্নরকম অতিরিক্ত বা পরিপূরক বস্তু, যেমন- চার্ট, মডেল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়, যেগুলিকে শিখন প্রদীপন বা শিক্ষাসহায়ক উপকরণ বলে।

বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা শিক্ষার্থীদের সামনে শিক্ষক বা শিক্ষিকা যে প্রদীপনটি ব্যবহার করবেন তা অবশ্যই বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হবে, তবেই বিষয়ের বোধগম্যতা বৃদ্ধি পেয়ে হৃদয়ঙ্গমে সহজ হয়ে উঠবে।
শিক্ষার্থীদের স্তর নির্ণয়ের যথার্থতা শিক্ষক-শিক্ষিকা যে প্রদীপনটি ব্যবহার করবেন তা যেন শিক্ষার্থীদের বোধগম্যতার স্তরভিত্তিক হয়। প্রদীপনটি এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে যার অর্থপূর্ণ ধারণা থাকবে এবং যার দ্বারা এটি সহজ - সরল ও বোধগম্য হয়ে উঠে শিক্ষার্থীদের কাছে।
আগ্রহ ও চিন্তার নির্দিষ্টকরণ শিক্ষক-শিক্ষিকা ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সামনে যে বিষয়সম্পর্কিত প্রদীপনটি তুলে ধরবেন সেটি অবশ্যই শিক্ষার্থীদের কাছে আগ্রহের সঞ্চার করবে। প্রদীপনটি এমনভাবে তুলে ধরতে হবে যাতে বিষয় সম্পর্কিত সঠিক চিন্তার বিকাশ ঘটে।
যথার্থ প্রদর্শন প্রদর্শিত প্রদীপনটি কৃষ্ণফলকের উপর না টাঙিয়ে তার বাম বা ডান দিকে টাঙাতে হবে, যাতে শ্রেণিকক্ষের সকল শিক্ষার্থীর কাছে প্রদীপনটি দৃষ্টিগোচর হয় এবং এটি উপযুক্ত রঙের Contrast ও Font size-এ হতে হবে।
উপযুক্ত ব্যবহার প্রদীপনটি শিক্ষার্থীদের সামনে নির্ভুলভাবে ব্যবহারের জন্য পয়েন্টার বা নির্দেশক দণ্ডের ব্যবহার করতে হবে। প্রদীপনটিকে শিক্ষার্থীদের কাছে যথাযথ বোধগম্য করে তুলতে হবে এবং কোন্ প্রদীপন কখন ব্যবহার করা হবে সে ব্যাপারে সতর্ক ও যত্নবান হতে হবে।

বিস্তৃতিকরণের দক্ষতা (Skill of Illustration)

পাঠদানের সম্পূর্ণরূপে দক্ষতা বা সার্থকতা নির্ভর করে পাঠের সঠিকরূপ বিস্তৃতিকরণের মাধ্যমে সহজ-সরলভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে বিষয়বস্তুর বিস্তৃত উপস্থাপনার উপর যা অত্যন্ত প্রয়োজন। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পূর্বজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিথস্ক্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে এই দক্ষতার দ্বারা শিক্ষার্থীর সার্বিক জ্ঞানার্জনের পথকে সুগম করতে পারেন।

এই বিষয়ক দক্ষতার কয়েকটি উপাদান হলো-

যথাযথ উদাহরণ প্রদান ধারণার বিশ্লেষণের জন্য বিষয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ উদাহরণের উপস্থাপনের মাধ্যমে বিষয়ের বোধগম্যতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর জন্য দেয় উদাহরণগুলি যেন বাস্তব জীবন থেকে গৃহীত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
বিষয়বস্তুর স্বচ্ছ উপস্থাপনা বিষয়বস্তুটিকে শিক্ষার্থীদের কাছে স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে বিষয়ের অভ্যন্তরস্থ জটিলতা শিক্ষার্থীদের মনোনিবেশের পথে বাধা না হয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে।
সহজ ও সারল্য সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় বিষয়বস্তু উপস্থাপন করতে হবে। ভাষা ও প্রশ্নের মান যেন শিক্ষার্থীদের বয়স ও সামর্থ্য অনুযায়ী হয়।
শিক্ষার্থীদের মিথস্ক্রিয়া শিক্ষার্থীদের মিথস্ক্রিয়া ভিন্ন বিষয়বস্তুর বোধগম্যতার সঠিকস্তরে বা মাত্রায় উন্নীত করা সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসু মনোভাব তাদের প্রেষণা স্তরকে জাগ্রত করে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।
সমধর্মী বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন বিষয়ের সঙ্গে সামজ্ঞস্যবিধানকারী সমধর্মী বিষয় বা বিষয়গুচ্ছের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বিষয়ের অন্তনির্হিত অর্থকে বোধগম্যতার শিখরে পৌঁছে দিতে হবে।

প্রবলন বা উৎসাহদানের দক্ষতা (Skill of Reinforcement)

Thorndike-এর প্রবর্তিত শিক্ষার তিনটি প্রধান সূত্রের একটি হলো - Law of Effect বা ফলাফলের সূত্র। এই সূত্রটির প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে উৎসাহ দানের দক্ষতার উপর। উৎসাহদান শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতাকে সমৃদ্ধ করে। উৎসাহদান শিক্ষার্থীদের মনোসংযোগ ও উদ্যমে প্রেষণা সঞ্চার করে। তদুপরি উৎসাহদান শ্রেণিকক্ষের শৃঙ্খলা বজায় রাখে।

ইতিবাচক ও নেতিবাচক উৎসাহদান উৎসাহদান প্রশংসাসূচক হতে পারে অর্থাৎ ইতিবাচক হতে পারে। এই ইতিবাচক উৎসাহদান সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে যে এটি যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়। আবার নেতিবাচক উৎসাহদান সম্পর্কেও সতর্ক থাকতে হবে, যেন শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয়।
ভুল প্রতিক্রিয়াকে ভেঙে দেওয়া বা দুর্বল করা শিক্ষার্থী যদি কোনো প্রশ্নের সাপেক্ষে ভুল প্রতিক্রিয়া দেয়, তৎক্ষণাৎ তা ভেঙে দিতে হবে নতুবা তাদের এই ভুল ধারণা তাদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণার জন্ম দেবে।
আরও তথ্য আহরণের নিমিত্তে মুখ্য প্রতিঘাত পরিবেশন শিক্ষার্থীর দেয় প্রতিক্রিয়া থেকেই তার আরও জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য তাকে এমনভাবে উৎসাহ দিতে হবে যেন তার মধ্যে থেকেই জ্ঞান আহরণের স্পৃহা তৈরি হয়।
ইতিবাচক অবাচনিক উৎসাহদান অনেক সময় উৎসাহদানের ক্ষেত্রে বাচনিক ভাষা প্রয়োগ না করেও অবাচনিক সম্মতিসূচক বা অসম্মতিসূচক ইঙ্গিতদানের মাধ্যমে কার্য সমাধা করা যায়।
কৃষ্ণফলকে শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া লিখন বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের দ্বারা দেয় প্রতিক্রিয়া বা উত্তরগুলি ঠিক হলে কৃষ্ণফলকে উৎকীর্ণ করা যায় তাতে শিক্ষার্থীদের নিজেদের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পায়।

আরো পড়ুনঃ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url