শ্রমের ধারণা | শ্রমের বৈশিষ্ট্য | শ্রমের প্রকারভেদ | শ্রমের গুরুত্ব

শ্রমের ধারণা (Concept of Labor)

ভূমির ন্যায় শ্রম উৎপাদনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি ছাড়াও যে কোন উৎপাদন অসম্ভব। তবে ভূমির ন্যায় শ্রম অবিনশ্বর নয়। সাধারণত শ্রম বলতে মানুষের শারীরিক পরিশ্রমকে বুঝায়। কিন্তু অর্থনীতিতে শ্রমকে এত সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হয় না। 

অর্থনীতিতে শ্রম বলতে উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত মানুষের শারীরিক ও মানসিক সকল প্রচেষ্টাকেই বুঝায়, যা অর্থ উপার্জনের সাথে সম্পৃক্ত। শ্রমের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়, অন্যদিকে তেমন মানসিক পরিশ্রমেরও প্রয়োজন হয়। 

শুধুমাত্র শারীরিক শ্রম যেমন শ্রম হতে পারে না, তেমনি আবার শুধুমাত্র মানসিক শ্রমও শ্রম হতে পারে না। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শারীরিক শ্রম বেশি আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানসিক শ্রম বেশি হতে পারে।

শ্রমের বৈশিষ্ট্য (Feature of Characteristics of Labor)

শ্রম বলতে উৎপাদন কাজে নিয়োজিত মানুষের শারীরিক ও মানসিক সকল প্রচেষ্টাকেই বুঝায়, যা অর্থ উপার্জনের সাথে সম্পৃক্ত। শ্রমের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়, অন্যদিকে তেমন মানসিক পরিশ্রমেরও প্রয়োজন হয়। শ্রমের যে সকল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় তা হলো -

১. শ্রম সর্বাপেক্ষা ধ্বংসশীল উপাদান (More demolished elements): শ্রম সর্বাপেক্ষা ধ্বংসশীল উপাদান। এটা একবার নষ্ট হলে চিরদিনের জন্য নষ্ট হয়ে যায়, আর পুনরায় ফিরে আসে না। যেমনঃ কোন শ্রমিক যদি একদিন পরিশ্রম না করে তবে তার ঐ দিনের শ্রমটি চিরদিনের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে, ঐদিনের ন্যায় তার শ্রমটিও আর ফিরে আসবে না। আবার বয়স বৃদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ে, ফলে তার শ্রমও ধ্বংস হয়ে যায়।

২. শ্রমের দরকষাকষির ক্ষমতা খুব কম (Lesser bargaining power): উৎপাদনে নিয়োজিত হওয়ার পূর্বে উৎপাদনের প্রত্যেক উপাদানের পারিশ্রমিকের ব্যাপারে মালিকের সাথে দরকষাকষি করার ক্ষমতা থাকে। কিন্তু শ্রমিকের এরূপ দরকষাকষি করার ক্ষমতা খুবই কম। এর কারণ হলো - শ্রম হলো সবচেয়ে ধ্বংসাশীল বস্তু, নিয়োগকর্তার চেয়ে শ্রমিকের সংখ্যাধিক্য এবং শ্রমের গতিশীলতা অপেক্ষাকৃত কম।

৩. শ্রমিক ও শ্রম অবিচ্ছিন্ন (Laborer and labor are insperable part): শ্রমিক ও শ্রমিকের সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন। অন্যান্য দ্রব্য বিক্রয়ের সময় বিক্রেতা তা ক্রেতার নিকট হস্তান্তর করতে পারে, কিন্তু শ্রম বিক্রয়ের সময় শ্রমিক তার শ্রমকে অন্যের নিকট হস্তান্তর করতে পারে না। একারণে যেখানে শ্রমের প্রয়োজন সেখানেই শ্রমিককে যেতে হয়। অর্থাৎ উৎপাদনের জন্য যেখানে শ্রমের প্রয়োজন, সেখানেই শ্রমিকের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।

৪. মজুরী বৃদ্ধির সাথে শ্রম যোগানের সম্পর্ক ঋণাত্মক (Reverse relation between increase of wages and supply of wages): শ্রমের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি পেলেই সকল শ্রমের যোগান বৃদ্ধি পাবে এমন নয়। বরং অনেক সময় তা হ্রাস পেতে পারে। এর কারণ হলো- অল্প পরিশ্রম করে অধিক পারিশ্রমিক পেলে শ্রমিকেরা অল্প সময় কাজ করে তাদের কাঙ্খিত অর্থ উপার্জন করতে পারে। ফলে তারা অতিরিক্ত কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অন্যদিকে শ্রমের মজুরী হ্রাস পেলে কাঙ্খিত উপার্জনের জন্য শ্রমিকেরা অধিক পরিমাণে কাজ করতে আগ্রহী হয়, এতে শ্রমের যোগান বৃদ্ধি পায়।

৫. শ্রম একটি জীবন্ত উপাদান (Labor is a living element): শ্রম একটি জীবন্ত উপাদান। এ কারণে শ্রমিক তার শ্রমকে বিক্রি করে, নিজেকে নয়। জমি ও মূলধনের সেবা এমন ক্রয় করা যায়, আবার প্রয়োজন হলে জমি ও মূলধনও ক্রয় করা যায়। কিন্তু শ্রমিকের সেবা ক্রয় করা গেলেও শ্রমিককে ক্রয় করা যায় না।

৬. শ্রমকে সংরক্ষণ করা যায় না (Labor can not be stored): উৎপাদনের অন্যান্য উপাদান যেমন ভূমি ও মূলধন ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করা গেলেও শ্রমিকের শ্রম কখনও ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করা যায় না। শ্রমিক যখন শ্রম প্রদান করে তখনই তার উপযোগিতা লাভ করা যায়। শ্রমিকের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতা যতই অপরিহার্য হোক না কেন, তার অনুপস্থিতিতে তা নিঃশ্বেষ হয়ে যায়।

৭. শ্রমের যোগান পরিবর্তনশীল (Supply of labor is flaxible): ভূমির যোগান স্থির হলেও শ্রমের যোগান পরিবর্তনশীল। শ্রমের যোগান দেশের কর্মক্ষম মানুষ ও তাদের কর্মদক্ষতার উপর নির্ভর করে। জন্মহার বৃদ্ধি, শিক্ষা-দীক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি ইত্যাদির দ্বারা শ্রমের যোগান বৃদ্ধি করা যায়। অন্যদিকে মৃত্যুহার বৃদ্ধি, শিক্ষা-দীক্ষার অবনতি ও শ্রমিকের দেশ ত্যাগের দ্বারা শ্রমের যোগান হ্রাস পায়। অবশ্য শ্রমের ন্যায় মূলধন ও সংগঠনের যোগানও পরিবর্তনশীল।

৮. শ্রম গতিশীল (Labor is transferable): শ্রমের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি একটি স্থানান্তরযোগ্য বা গতিশীল উপাদান। উৎপাদনের অন্যতম উপাদান ভূমির গতিশীলতা একেবারেই নেই, আবার মূলধনের গতিশীলতা থাকলেও তা শ্রমের ন্যায় ততটা নয়। তবে ভাষা, দেশ, জাতি, ভৌগলিক অবস্থান ইত্যাদি শ্রমের স্থানান্তরযোগ্যতা বা গতিশীলতার পথে বাধা হিসেবে গণ্য হয়।

৯. শারীরিক ও মানসিক শ্রম (Combination of physical and mental labor): শ্রমের সাথে ব্যক্তির শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রমের বিষয়টি জড়িত। মানসিক শ্রম ছাড়া শুধুমাত্র শারীরিক শ্রম যেমন শ্রম হিসেবে গণ্য হয় না, তেমনি শারীরিক শ্রম ছাড়া শুধুমাত্র মানসিক শ্রমও শ্রম হিসেবে বিবেচিত হয় না। তবে এ দু'প্রকার শ্রমের অনুপাতে কমবেশি হতে পারে। যেমনঃ একজন রিক্সাচালক রিক্সা চালানোর সময় শারীরিক শ্রম বেশি করলেও মানসিক শ্রম একেবারেই করেন না, তা কিন্তু নয়। তিনি প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ব্রেক ধরেন বা বেল বাজান, যেটি মানসিক শ্রমেরই বহিঃপ্রকাশ। আবার অফিসের বড়কর্তা মানসিক শ্রম বেশি করেন এবং শারীরিক শ্রম কম করেন।

১০. অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্য (Objective of labor is to earn money): কোন মানুষের কর্ম প্রচেষ্টা যদি অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে সম্পাদিত হয় তবেই তাকে শ্রম বলা যাবে, অন্যথায় নয়। যেমন - কোন ব্যক্তি যদি নিছক আনন্দ উপভোগের জন্য কোন শ্রম ব্যয় করেন তবে অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ হতে তা কোন অবস্থাতেই শ্রম হিসেবে বিবেচিত হবে না। যেমনঃ আমরা যদি নিছক আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যে ক্রিকেট খেলি তবে তা শ্রম নয়, কিন্তু একজন পেশাদার ক্রিকেটার যদি ক্রিকেট খেলেন তবে তা শ্রম হিসেবে গণ্য হবে।

শ্রমের প্রকারভেদ (Types of Labor)

প্রাচীনকাল হতেই অর্থনীতিবিদগণ  শ্রমকে -

১. উৎপাদনশীল শ্রম এবং 

২. অনুৎপাদনশীল শ্রম 

এ দু'ভাগে ভাগ করেছেন।

আধুনিক মতবাদ অনুযায়ী, উৎপাদনশীল শ্রম

যে শ্রম কোন উপযোগ সৃষ্টি করে তাকেই উৎপাদনশীল শ্রম বলে। শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবির কাজ উৎপাদনশীল শ্রম।

আধুনিক মতবাদ অনুযায়ী, অনুৎপাদনশীল শ্রম

যে শ্রম কোন উপযোগ সৃষ্টি করতে পারে না তাকে অনুৎপাদনশীল শ্রম বলে। যেমনঃ রাজমিস্ত্রির দালান তৈরির কাজ অনুৎপাদনশীল শ্রম।

শ্রমের গুরুত্ব (Importance of Labor)

যেকোনো প্রকার পণ্য বা সেবা উৎপাদন করতে হলে শ্রম বা শ্রমিকের উপস্থিতি অপরিহর্য। আবার শ্রমিক শুধুমাত্র উৎপাদনই করে না, ভূমি ছাড়া উৎপাদনের অন্যান্য উপাদানের যোগানদাতাও বটে। ভূমির মধ্যে থেকেই শ্রমিক তার শ্রম দিয়ে একাধিকে যেমন উৎপাদন কার্য সম্পাদন করে, অন্যদিকে শ্রমিকের উপার্জিত আয় সঞ্চয়ের মাধ্যমেই মূলধনের সৃষ্টি করে, যা পরবর্তীতে উৎপাদনের উপাদান হিসেবে গণ্য হয়। নিম্নে উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে শ্রমের গুরুত্ব আলোচনা করা হলোঃ

  • উৎপাদনের জন্য যত ধরনের বস্তুগত উপাদান দরকার, তা সংগ্রহ ও উৎপাদন স্থানে আনায়নের জন্য শ্রম অপরিহার্য।

  • সংগৃহীত উপায়-উপাদানগুলোর যথাযথ ব্যবহার একমাত্র শ্রমেই মাধ্যমেই সম্ভব। শ্রম ছাড়া এ সকল উপাদান ব্যবহারের কথা কল্পনাই করা যায় না।

  • শ্রমের কারণেই উৎপাদন ক্ষেত্রে নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, গবেষণা ইত্যাদির মাধ্যমে আধুনিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করা সম্ভব হচ্ছে।

  • একজন শ্রমিকের অভিজ্ঞতার দ্বারা অন্য শ্রমিক তার জ্ঞানের পরিধিকে পরিপূর্ণ করে, ফলে ক্রমান্বয়ে প্রতিটি শ্রমিকের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়।

  • শ্রম শুধুমাত্র উৎপাদনের উপাদানই নয়, তা উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ভোক্তাও বটে। তাই বলা যায়, শ্রমের দ্বারা একদিকে যেমন উৎপাদন কার্য সম্পাদন করা হয়, অন্যদিকে তেমন উৎপাদনের উদ্দেশ্যও অর্জিত হয়।

আরো পড়ুনঃ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url