শব্দ দূষণ কাকে বলে? শব্দ দূষণ প্রতিরোধের কৌশল

শব্দ দূষণ কাকে বলে?

বিভিন্ন উৎষ থেকে উৎপন্ন জোরালো ও অপ্রয়োজনীয় শব্দ যখন মানুষের সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে বিরক্তি ঘটায় এবং স্বাস্থ্যের ক্ষতি সাধন করে তখন তাকে শব্দ দূষণ বলে।

শব্দ আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম। আমাদের মনোভাব আদান-প্রদান, নিজেকে অন্যের কাছে প্রকাশ এবং অন্যকে জানার ও বোঝার অন্যতম উপায়। শব্দ আমাদের মনের ক্ষুধা মেটায়। পাখির ডাক, সুরেলা কণ্ঠের গান, প্রিয় জনের মিষ্টি কথা। রেডিও টেলিভিশনের শব্দ সবই নিঃসন্দেহে আমাদের আনন্দ দেয়। 

আবার কখনও কখনও কোনো কোনো শব্দ আমাদের কষ্ট বা বেদনার উদ্রেক করে। তবুও শব্দ আমাদরে প্রয়োজন। কিন্তু শব্দ অনেক সময় আমাদের বিভিন্নভাবে ক্ষতি করে। যেমন পরীক্ষার রাতে পাশের বাড়িতে উচ্চ রবে মাইকে গান। সাউন্ড বক্সে অতি উচ্চ স্বরে মিউজিক। এসব শব্দ আমাদের মনোযোগ বিঘ্ন ঘটায়। মেজাজ খারাপ করে ফেলে। গাড়ির হর্ণ, মেঘের গর্জন, যানবাহনের বিকট আওয়াজ, হাট বাজারের হট্টগোল, বিভিন্ন যন্ত্র কলকারখানার শব্দ, প্লেনের শব্দ, জেনারেটরের শব্দ, এ ধরনের অতি শব্দ দ্বারা পরিবেশ নষ্ট হয়। এ অবস্থাকে শব্দ দূষণ বলে।

অবিরত উচ্চ শব্দে কানের ভেতরের পর্দা ফেটে যায়, বা অন্তঃপর্দার কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়, ফলে মানুষ স্থায়ীভাবে বধির হয়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) -এর মতে, সাধারণত 60 ডেসিবেল শব্দ একজন মানুষকে সাময়িকভাবে এবং 100 ডেসিবেল শব্দ পুরোপুরিভাবে বধির করে ফেলে। পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে অতি শব্দ মানুষের মানসিক এবং দৈহিক ক্ষতির কারণ।

পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে জানা গেছে উচ্চ শব্দ মানুষের মস্তিষ্কে স্নায়বিক চাপ সৃষ্টি করে। অর্থাৎ স্নায়ুর স্বাভাবিক সংযোগ ব্যহত করে, কাজে মনোযোগ কমিয়ে দেয়, মেজাজ খিটখিটে করে, কর্মদক্ষতা কমিয়ে দেয়, পরিপাক ক্রিয়া ব্যহত করে। পাকস্থলী ও পরিপাক তন্ত্রের পীড়া বা ব্যাধি সৃষ্টি করে। আলসার ও আন্ত্রিক পীড়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বাড়িয়ে দেয়। যারা নিয়মিত উচ্চ শব্দে স্টিরিও বা টেলিভিশন চালান, যারা সারাক্ষণ কানে মাইক্রোফোন লাগিয়ে উচ্চ স্বরে গান শোনে তাদের পেটের পীড়া ও কানের অসুখ দেখা দেয়, বিশেষ করে শ্রবণ শক্তি ধীরে ধীরে কমে যায়।

ফলে অল্প বয়সেই বধিরতা আসতে পারে। গবেষণা করে দেখা গেছে যে সব শিল্প কারখানায় যন্ত্রে উচ্চ শব্দ উৎপন্ন হয় সেখানকার শ্রমিকদের শ্রবণ শক্তি দশ বছরে প্রায় অর্ধেক হ্রাস পায়। গবেষণায় জানা যায় ৯৭% শিক্ষার্থীর মন্তব্য উচ্চ শব্দের কারণে পড়াশুনায় বিঘ্ন ঘটে। ৮৬% সাধারণ মানুষের মন্তব্য উচ্চ শব্দে মাথা ব্যথা, মেজাজ খিচিয়ে যাওয়া, ঘুমের ব্যাঘাত, কানে কম শোনাসহ এ ধরনের মারাত্মক ক্ষতি হয়। জ্যামে আটকে পড়া গাড়ীর হর্ণ ও শব্দ যাত্রী এবং ড্রাইভারদের জন্য শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে অত্যন্ত ক্ষতিকারক।

শব্দ দূষণ প্রতিরোধের কৌশল

শব্দ দূষণ সকল পেশার সকল বয়সের মানুষের জন্য ক্ষতিকর এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তাই সকলকেই শব্দ দূষণ প্রতিরোধের জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। উচ্চ শব্দে রেডিও, টেলিভিশন, বা লাউড স্পিকার, মাইক না বাজানো। উচ্চ স্বরে মাইকে নির্বাচনী প্রচারণা, রাজনৈতিক বক্তৃতা, ক্যানভাসিং, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিয়ে বাড়িতে গীত বাদ্য চিৎকার হৈ হল্লা করে অন্যের অসুবিধা সৃষ্টি থেকে বিরত থাকতে হবে। শব্দ দূষণ প্রতিরোধের জন্য নিম্নরূপ তিনটি কৌশল নেয়া যেতে পারে।

আরো পড়ুনঃ ব্যবসায় দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে - ব্যাখ্যা কর।

নিজেকে এবং আপনার গৃহ পরিবেশটি কোলাহল মুক্ত রাখুনঃ যখন শব্দের উৎস আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে তখন আপনি নিজের বাড়ি বা ঘরগুটি শব্দ নিরোধক করুন। গৃহ নির্মাণের শব্দ নিরোধক নির্মাণ সামগ্রী ও কৌশল ব্যবহার করুন। এজন্য শব্দ নিরোধক ইট, ফোমের শীট, ভারী পর্দা, দেয়ালে বুকসেলফ ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়। যেসব যন্ত্রপাতি থেকে শব্দ হয় সেগুলো বসবাসের বাবার ঘর থেকে দূরে রাখুন। কোলাহল বাসস্থান থেকে দূরে থাকুন। কাজের জন্য অনেক সময় হয়তো তা সম্ভব না হতে পারে।তবুও যতটা সম্ভব কোলাহলমুক্ত স্থানের সময় কাটানোর চেষ্টা করুন। ধ্যান মগ্নতা বা যোগ অভ্যাস দ্বারাও অনেক সময় শব্দ দূষণ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়। যখন খুব অস্বস্তি বোধ করবেন তখন চুপচাপ বসে গভীর শ্বাস নিন এবং একাগ্র মনে শব্দকে তুচ্ছ জ্ঞান করে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলুন। এভাবে দশ বার করুন। আপনার অস্বস্তি বোধ কেটে যাবে। বাইরের শব্দ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে নয়েজ ক্যান্সেলিং হেড ফোন বা ইয়ার প্লাগ ব্যবহার করতে পারেন। কোনো কোনো ওষুধের দোকানে এগুলো কিনতে পাওয়া যায়। অথবা তুলা বা কাপড়ের দলা পাকিয়ে নিজের কানের ছিদ্রটি বন্ধ রাখতে পারেন।

আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরের উৎস সম্পর্কে করণীয়ঃ শব্দ দূষণের কারণটি বুঝার চেষ্টা করুন। নির্মাণাধীন এলাকা, বিমান বন্দর, রেল স্টেশন, ব্যস্ত রাজপথ উচ্চ শব্দের উৎস। এটি আপনার এলাকায় হলে আপনি এ সম্পর্কে ভাল বুঝবেন। আপনি দূষণ এলাকার বসবাস তুলে নিন। আপনার এলাকায় বা মহল্লায় শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কোনো বিধি বিধান আছে কিনা জেনে নিন। সাধারণত নির্মাণ কাজের ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য দিনের মধ্যে কিছু সময় বেধে দেয়া থাকে। সেই সময়ে যাতে কাজ হয় তা নিশ্চিত করুন। বিধান ভঙ্গ হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নিন।

আরো পড়ুনঃ ব্যবসা- বাণিজ্যের উন্নতি নির্ভর করে ব্যবসায় পরিবেশ এর ওপর - ব্যাখ্যা করো।

নিজ এলাকা ও এলাকাবাসীদের শব্দ দূষণমুক্ত রাখায় করণীয়ঃ লক্ষ্য করে থাকবেন আপনি যে এলাকায় বা মহল্লায় বা পাড়ায় বসবাস করেন প্রায়শ সেখানে নির্বাচনী প্রচারণা, রাজনৈতিক বক্তৃতা, ক্যানভাসিং, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিয়ে বাড়ি, জন্মদিন, খৎনা বিভিন্ন সামাজিক উৎসবে সারা রাত অত্যন্ত জোরালো শব্দে মাইক বাজানো হয়। অনেক সময় কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা কনসার্ট আয়োজন করা হয়। মাত্র এক রাতের জন্য হলেও এতে বেশির ভাগ সময়ই পরীক্ষার্থীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতি হয়। এটি হৃদরোগী, অতি বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে। তাই এ ধরনের দূষণ প্রতিরোধের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এ ব্যাপারে স্থানীয় জন প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করুন, তাদের শব্দ দূষণের ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝিয়ে দিন। এলাকায় জন সাধারণকে এ সম্পর্কে সচেতন করুন। এরপর প্রথম কাজ হবে সকলে মিলে কমিউনিটি সেন্টার বা শব্দ উৎসের জন্য এমন একটি স্থান নির্বাচনের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ যাতে এলাকাবাসীর জন্য শব্দ দূষণ সর্বনিম্ন হয়। দ্বিতীয়ত লাউড স্পিকার ব্যবহারের একটি সময় সীমা এবং শব্দ তীব্রতার সর্বোচ্চ মান ৫০ ডেসিবেল বেঁধে দিতে হবে। এটিও সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজনে আইনী বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিতে পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রে একা নয় বরং কয়েকজন মিলে সম্মিলিত প্রচেষ্টা নিতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url