সামষ্টিক অর্থনীতি কাকে বলে?

সামষ্টিক অর্থনীতি কাকে বলে?

সামষ্টিগত অর্থনীতি বা Macro Economics এর Macro শব্দের অর্থ বড়। এ শব্দটি গ্রিক শব্দ Makros থেকে এসেছে। সুতরাং শব্দগত দিক থেকে সমষ্টিগত অর্থনীতি গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করে। 

অর্থনীতির এ শাখা বিভিন্ন ক্ষুদ্র একক যেমন - বিশেষ ব্যক্তি, উৎপাদক, একক পরিবার বা শিল্প সম্বন্ধে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করে না। বরং এটি বৃহত্তর পরিবেশে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে। অর্থাৎ সমষ্টিগত অর্থনীতি ব্যক্তির আয়ের পরিবর্তে জাতীয় আয়, ব্যক্তির উৎপাদনের পরিবর্তে জাতীয় উৎপাদন, নির্দিষ্ট দ্রব্যের পরিবর্তে দ্রব্যসমষ্টি, দ্রব্যমূল্যের পরিবর্তে সাধারণ মূল্যস্তর, ব্যক্তিগত বিনিয়োগের পরিবর্তে জাতীয় বিনিয়োগ, ব্যক্তিগত ভোগের বদলে জাতীয় ভোগ প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে। 

অধ্যাপক একলি (Ackley) সমষ্টিগত অর্থনীতিকে একটি হাতির সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন যে, হাতির আকার, আয়তন ও কর্মধারা বিশ্লেষণের সাথে সমষ্টিগত অর্থনীতির মিল আছে। কিন্তু সে হাতির অঙ্গপত্যঙ্গের বর্ণনা ও তাদের পৃথক ক্রিয়াকর্ম সমষ্টিগত অর্থনীতির বিষয় হতে পারে না। সমষ্টিগত অর্থনীতির চিন্তাধারার ক্ষেত্রে জে এম কেইনসারের অবদান সীমাহীন। উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সমষ্টিগত অর্থনীতির তাত্ত্বিক কাঠামো নিম্নোক্তভাবে প্রকাশ করা যায়।

সমষ্টিক ও ব্যষ্টিক অর্থনীতি

অধ্যাপক রাগনার ফ্রিশ (Ragnar Frisch) ১৯৩৩ সালে সর্বপ্রথম অর্থনীতিকে সমষ্টিক এবং ব্যষ্টিক -এ দু'ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। গ্রীক শব্দ 'Mikros' থেকে Microeconomics বা ব্যষ্টিক অর্থনীতি পরিভাষার উৎপত্তি। Mikros শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো ‘ক্ষুদ্র' (Small or tiny)। 

সুতরাং ব্যষ্টিক অর্থনীতি বলতে অর্থনীতির সেই শাখাকে বুঝায় যা একটি অর্থনীতির একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে আলোচনা করে বা প্রতিটি অর্থনৈতিক সমস্যাকে পৃথক পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করে। কাজেই পৃথক পৃথকভাবে পরিবারবর্গ, বাজার, উৎপাদন প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির আচরণ বিশ্লেষণ ব্যষ্টিক অর্থনীতির বিষয়বস্তু। 

উদাহরণস্বরূপ মনে করুন, আপনি জানতে চান কী কী বিষয় দ্বারা পেট্রোলের দাম নির্ধারিত হয়, কীভাবে একটি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের ভারসাম্য উৎপাদন ও দাম নির্ধারিত হয় অথবা কী কী বিষয় দ্বারা একটি পরিবারের চিকিৎসা-ব্যয় নির্ধারিত হয় - এক্ষেত্রে আপনি নিশ্চিতভাবেই ব্যষ্টিক অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছেন। 

অন্যদিকে, সামগ্রিক উৎপাদন, দামস্তর, জাতীয় আয়ের অংশ হিসেবে মোট চিকিৎসা-ব্যয় প্রভৃতি সমষ্টিক অর্থনীতির বিষয়বস্তু। 

ব্যষ্টিক ও সমষ্টিক অর্থনীতির পার্থক্য একটি সহজ উপমার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। মনে করুন, আপনি হেলিকপ্টারে চড়ে একটি ঘন অরন্যের উপর দিয়ে যাচ্ছেন। অরন্যের যে সার্বিক দৃশ্য আপনার চোখে প্রতিভাত হবে তা সমষ্টিক অর্থনৈতিক চিত্রের সাথে তুলনীয়।

অন্যদিকে, অরন্যের প্রতিটি বৃক্ষের পৃথক পৃথক পর্যবেক্ষণ ব্যষ্টিক অর্থনৈতিক সমস্যার সাথে তুলনীয়। 

ব্যষ্টিক ও সমষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম প্রধান পার্থক্য হলো এই যে, ব্যষ্টিক অর্থনীতি মূলতঃ তুলনামূলক দাম (relative prices) নিয়ে আলোচনা করে। 

মনে করুন, প্রতি ডজন আপেলের দাম ৫০ টাকা এবং প্রতি ডজন কমলার দাম ২৫ টাকা। তুলনামূলক দাম বলতে প্রতি ডজন আপেলের পরিবর্তে কত ডজন কমলা পাওয়া যায় তাকে বুঝায়। বস্তুতঃ তুলনামূলক দাম ব্যষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের মূল চালিকা-শক্তি। সমষ্টিক অর্থনীতিতে তুলনামূলক দামের সংশ্লিষ্টতা (relevance) থাকলেও মূলতঃ তাত্ত্বিক আলোচনায় তা পরিহার করা হয়।

উপর্যুক্ত পার্থক্যসমূহ মেনে নিয়েও বলা যায় যে, ব্যষ্টিক ও সমষ্টিক অর্থনীতির মধ্যে কোন প্রকার ক্ষুর-ধার পার্থক্য নির্ণয় সম্ভব নয়।

সাধারণ অর্থনৈতিক তত্তে¦ এর যে কোন একটিকে পৃথকভাবে আলোচনা করা অত্যন্ত দূরুহ বিষয়। যদিও ব্যষ্টিক অর্থনীতি একটি অর্থব্যবস্থার অংশ বিশেষকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে এবং সমষ্টিক অর্থনীতি একটি অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র ব্যাখ্যা করে তথাপি এ দু'প্রকার বিশ্লেষণের সাধারণ দিক (overlapping) রয়েছে। মূলতঃ অর্থনীতির সামগ্রিক কার্যক্রম এর অংশসমূহের কার্যক্রমের উপর নির্ভরশীল। কাজেই অংশ পৃথকভাবে আলোচনা করা কঠিন। একটি দেশের মোট উৎপাদন শত-সহস্র উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের পৃথক পৃথক সিদ্ধান্তের ফসল। অন্যদিকে, প্রতিটি উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, পরিবার, ব্যক্তির পৃথক পৃথক সিদ্ধান্ত অংশত পুরো অর্থনীতির কর্মকান্ডের পর নির্ভর করে। 

সুতরাং ব্যষ্টিক ও সমষ্টিক অর্থনীতি একে অন্যের পরিপূরক (complentary), বিকল্প (substitute) নয়। অধ্যাপক স্যামুয়েলসনের কথায়, 'There is really no opposition between macro and micro economics. Both are absolutely vital. And you are only half - educated if you understand the one being ignorant of the other'. 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url