সামাজিক পরিবর্তন কাকে বলে? সামাজিক পরিবর্তনের কারণসমূহ

সামাজিক পরিবর্তন কাকে বলে?

সমাজ গতিশীল। পরিবর্তনশীলতা এর ধর্ম। আজ আমরা যে সামাজিক পরিমণ্ডলে বসবাস করছি তা পূর্বে ছিল না এবং বর্তমান কাঠামোও আগামী দিনে থাকবে না। সামাজিক পরিবর্তন বলতে বুঝায় সমাজের কাঠামোর পরিবর্তন। সমাজ কাঠামো বলতে বুঝায় সমাজের প্রধান প্রধান দল ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত রূপ। 

মূলত দল ও প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তনই সামাজিক পরিবর্তন। 

জিন্স বার্গ বলেন, “সামাজিক পরিবর্তন হলো সমাজ কাঠামো এবং তৎসম্পর্কিত কার্যাবলীর পরিবর্তন এবং যেসব আদর্শ বা মূল্যবোধ এবং সামাজিক বিধি সামাজিক কাঠামোকে সংহত করে রাখে এবং এর বিভিন্ন অংশের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে তার পরিবর্তন”।

গার্থ ও মিল্স বলেন, “কালের গতিতে রীতিনীতি এবং সমাজ ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন ঘটে তাকে সামাজিক পরিবর্তন বলে”।

কার্ল মার্কস বলেন, “সামাজিক পরিবর্তন হচ্ছে সমাজের মৌল কাঠামো বা অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন যার উপর ভিত্তি করে সমগ্র উপরিকাঠামোর পরিবর্তন সংঘটিত হয়”।

উইলিয়াম এফ অগবার্নের মতে, সামাজিক পরিবর্তন হলো, “সমাজে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পরিবর্তন”।

সহজ কথায় সামাজিক পরিবর্তন হলো সমাজের আচার – আচরণ, ধ্যান – ধারণা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, শিল্পকলা, রাজনীতি, অর্থনৈতিক উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন।

সামাজিক পরিবর্তনের কারণসমূহ

সামাজিক পরিবর্তন হচ্ছে সমাজের রূপান্তর বা রদবদল। সমাজের এ পরিবর্তন, রূপান্তর বা রদবদলের কতগুলো কারণ রয়েছে। যেমনঃ

ভৌগলিক কারণঃ ভৌগলিক পরিবেশ ও ভৌগলিক অবস্থা আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনুকূল ভৌগলিক পরিবেশে সভ্যতা বিকশিত হয়েছে। ভৌগলিক ও জলবায়ুর পরিবর্তনে সামাজিক পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। যেমনঃ কোনো নদী শুকিয়ে গেলে এর তীরবর্তী মৎস্যজীবীদের পেশা পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। নদী ভাঙন বা ক্রমবর্ধমান জলবায়ুর পরিবর্তন নগর-স্থানান্তরকে উৎসাহিত করে।

আন্দোলনঃ সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে আন্দোলন বা বিপ্লব। সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সতীদাহ প্রথা রদ, বিধবা বিবাহের প্রচলন, নারী শিক্ষা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন বিলোপ ইত্যাদি সংস্কার সাধিত হয়েছে। ফরাসি, বিপ্লব সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা, শ্রেণি ও সামাজিক স্তরবিন্যাসের আমূল পরিবর্তন করেছে। গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার, নারীর সমতা (জেন্ডার), পরিবেশ, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ে আন্দোলন মানুষকে অধিকার সচেতন করে যা সামাজিক পরিবর্তনকে ত্বরাণ্বিত করছে।

উৎপাদন ব্যবস্থাঃ দীর্ঘমেয়াদে সমাজের দৃশ্যমান পরিবর্তন সাধনে উৎপাদন ব্যবস্থার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। দাস নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা হতে সামন্ত উৎপাদন ব্যবস্থায় উত্তরণের মাধ্যমে ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল। একইভাবে সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উত্তরণের মাধ্যমেও সমাজের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। কৃৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা গ্রামীণ সমাজের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু শিল্পোৎপাদন এবং সেবাখাত নগর সমাজের বৈশিষ্ট্য। কোনো সমাজে ব্যাপকভাবে শিল্পায়ন হলে সেখানে নগরায়ন ত্বরান্বিত হয়। ফলে সমাজ সনাতন ব্যবস্থা থেকে আধুনিকায়নের দিকে অগ্রসর হয়।

শিক্ষাঃ সামাজিক পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। অজ্ঞতা, অন্ধত্ব, কুসংস্কার ইত্যাদি হতে মুক্তি দিয়ে শিক্ষাই মানুষকে সমাজোপযোগী করে তোলে। এ জন্য শিক্ষা সামাজিকীকরণের প্রধান মাধ্যম। শিক্ষা একটা সমাজ ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে পারে। শিক্ষা মানুষের পেশা, রুচি, আচার-আচরণ, মূল্যবোধ এবং আর্থিক সক্ষমতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।

সরকার ও রাজনীতিঃ সামাজিক পরিবর্তনে সরকার ও রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রত্যয়। ভারতীয় সামাজিক পরিবর্তনে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে ধর্মনিরপেক্ষতা কিংবা ধর্মীয় মৌলবাদ, প্রগতিশীলতা কিংবা সাম্প্রদায়িকতা সমাজকেও ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। গণতান্ত্রিক সরকার এবং সামরিক সরকারের শাসনামলে সমাজে অনেক পার্থক্য ও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। ধর্মীয় মৌলবাদী আদর্শের রক্ষণশীল সরকার ও প্রগতিশীল সরকারের শাসনামলেও সমাজের স্বাতন্ত্র ধারার পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।

ধর্মীয় চেতনাঃ ধর্মীয় চেতনার যৌক্তিকতার বিকাশ সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম নিয়ামক। সমাজে যখন নানারকম অনাচার, অসামাজিকতা বৃদ্ধি পায় তখন ধর্মীয় চেতনা ও আদর্শ সুস্থ সামাজিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারে। মুহাম্মদ (সা.), যীশুখ্রিস্ট, গৌতম বুদ্ধ প্রমুখ ধর্মীয় চেতনা ও আদর্শের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সামাজিক পরিবর্তন সংঘটনে সক্ষম হয়েছিলেন।

প্রচার-প্রচারণাঃ কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে সামনে রেখে ব্যাপক প্রচার - প্রচারণা চালানো হলে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি সামাজিক পরিবর্তনও অনিবার্য হয়ে পড়ে। স্বদেশী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিদেশী পণ্য বর্জন করে দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহার ব্রিটিশ ভারতের সমাজে দৃশ্যমান পরিবর্তন এনেছিল। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়ে বহুমুখী প্রচারণার ফলে সমাজের নেতৃত্ব, ক্ষমতা কাঠামো ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। বাল্যবিবাহ, যৌতুকপ্রথা, পরিবার পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে প্রচারণাও সামাজিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে।

গণমাধ্যমঃ আধুনিক সমাজের অনিবার্য উপাদান হচ্ছে গণমাধ্যম। পত্র - পত্রিকা, টেলিভিশন, বেতার, ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক পরিবর্তনে গণমাধ্যমের ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যম জনমত গঠন এবং সামাজিক আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারে। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে গণমাধ্যম পরিবর্তন আনয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সামাজিক পরিবর্তনের পূর্বশর্ত বলা যেতে পারে। ভাষাগত কিংবা অবকাঠামোগত যোগাযোগ ব্যবস্থা যখন খুব অনুন্নত ছিল তখন সমাজও ছিল বদ্ধ, স্থির এবং অনগ্রসর। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা যত উন্নত হয়েছে সামাজিক পরিবর্তনও তত দ্রুততর হয়েছে। গ্রামের সাথে শহরের সড়ক, রেল বা জলপথের যোগাযোগ নিশ্চিত হলে গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হতে বাধ্য। উত্তরবঙ্গ মঙ্গা নিরসনে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ভূমিকা অনস্বীকার্য। টেলিফোন, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ইত্যাদি যোগাযোগ ব্যবস্থা সমাজ জীবনে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নঃ ঐতিহ্যবাহী সমাজ থেকে আধুনিক সমাজে উত্তরণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান সর্বাধিক। বাষ্পীয় ইঞ্জিন থেকে আজকের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আর্থ - সামাজিক উন্নয়ন, উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন, সামাজিক সম্পর্ক ও শ্রেণি, পেশা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব অনস্বীকার্য।

আরো পড়ুনঃ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url